গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ৮৫ জন কাতরাচ্ছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। এর মধ্যে ৭১ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন সাভার সিআরপিতে। বাকি ১৪ জন মিরপুরসহ সিআরপির বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চে। আহতদের বেশির ভাগই মেরুরজ্জুতে পুলিশের গুলি ও বুলেটের আঘাতপ্রাপ্ত। গুলিতে কারও কারও হাত-পা এমনকি পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। আহতদের মধ্যে অনেকের পঙ্গুত্বের ঝুঁকি রয়েছে সারাজীবনের জন্য। সাভার সিআরপিতে চিকিৎসাধীন কয়েকজনের ভবিষ্যৎ ভরসা হুইলচেয়ার। চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করার চেষ্টা এবং মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সিআরপি কর্তৃপক্ষ।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা বানিয়ারি গ্রামের বাদশা মিয়া। চোখে-মুখে স্বপ্ন ছিল সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেক বড় হবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা, সেই দুশ্চিন্তায় এখন সাভারের সিআরপিতে দিন পার করছেন। বাদশা যায়যায়দিনকে জানান, গাজীপুরে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে কোচিং শেষ করে মিরপুরে থাকতেন। ছাত্র আন্দোলনেও ছিল যাতায়াত। ৫ আগস্ট বিকালে আওয়ামী সরকার পতনের পর বিজয় মিছিলে যান। মিছিলটি যখন মিরপুর ২ নম্বর থানার কাছাকাছি আসে তখন মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এতে বাদশার শরীরে ছয়টি গুলি লাগে। এর মধ্যে একটি বুলেট তার বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশের হাতের ওপর দিয়ে বেড় হয়। বর্তমানে তার হুইলচেয়ারই ভরসা। তিনি বলেন, জীবনে আর কোনোদিন হাঁটতে পারবেন কিনা, তাও জানেন না।
আরেক শিক্ষার্থী শান্ত পাল সাভারের বাইপাইল আশুলিয়া এলাকায় মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। চলছিল এইচএসসি পরীক্ষা। চারটি বিষয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। আন্দোলনের সময় ডান উরুতে গুলি লাগে। বর্তমানে সিআরপি সাভারে চিকিৎসাধীন। শান্ত পাল জানান, এই গুলির কারণে তার জীবন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তার ওপর রয়েছে অর্থ সংকট।
ভোলার লালমোহন উপজেলার করিমগঞ্জ গ্রামের জহিরুল ইসলাম সুজন (৩৬)
সংসার চালানোর জন্য কয়েক বছর আগে ঢাকায় আসেন। মতিঝিলে কাজ করতেন ফাস্টফুডের দোকানে। এই দিয়ে চলত তার সংসার। কিন্তু ১৮ জুলাই নটরডেম কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলিটি তার বুকের ডান পাশে লাগে। বর্তমানে সাভার সিআরপির বেডে কাতরাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা হাতিমারা গ্রামের আশরাফুল যাত্রাবাড়ী থেকে টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন। বাবা জহিরুল ইসলাম আর তার আয়ে চলত ৭ সদস্যের পরিবার। আশরাফুল বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি ৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন। এ সময় পুলিশের গুলি তার ডান কাঁধে সামনের দিক দিয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এখন বুক থেকে নিচের দিকে সারা শরীর অবশ হয়ে আছে।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে যাত্রাবাড়ীর একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হন। ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে সিআরপিতে ভর্তি করা হয়। এখানে খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি কর্তৃপক্ষ দিলেও পরিবারের সদস্যরা অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
মো. সুজন (১৭) নামে এক অটোরিকশা চালক জানান, গত ১৯ জুলাই দুপুরের দিকে কদমতলি থানার কাছাকাছি যাওয়ার পর পেছন থেকে গুলি এসে তার মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে বাম পাশ হয়ে বেরিয়ে যায়। এতে তার খাদ্যনালী ছিঁড়ে যায়। এখনো হাসপাতালের বেড থেকে ওঠার সামর্থ্য নেই।
করুণ সুরে বলেন, একদিকে অর্থ সংকট রয়েছে, অন্যদিকে জীবন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
সাভার সিআরপির রিহ্যাবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অফিসার মুঈদ হোসেন রেশাদ জানান, সাভার সিআরপিতে ৭১ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সিআরপির মিরপুর ব্র্যাঞ্চে রয়েছে ১৪ জন। চিকিৎসার পাশাপাশি আহতদের মানসিক সাপোর্ট খুবই জরুরি।