মেঘনার অভয়াশ্রমে বন্ধ করা যাচ্ছে না ইলিশ শিকার
প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
হিজলা (বরিশাল) প্রতিনিধি
মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীর অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মা-ইলিশ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা নিয়ে এসব এলাকায় দিন-রাত মা ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। এর পেছনে এখন বিএনপির নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জেলেরা জানিয়েছেন।
মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হচ্ছেন। অভিযান শুরুর প্রথম পাঁচদিনে তিন দফায় হামলার শিকার হয়েছেন তারা। সর্বশেষ গত শুক্রবার বিকালে হিজলা-গৌরব্দী ইউনিয়নের অরাকুল বাজারের ৭ নম্বর ঘাটসংলগ্ন মেঘনা নদীতে অভিযান চালাতে গেলে হামলা শিকার হয়েছেন হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), একজন আনসার সদস্য ও মৎস্য বিভাগের তিন কর্মচারী।
হিজলার ইউএনও জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখানে দুই ধরনের জেলে দুই এলাকায় মাছ ধরেন। মূল মেঘনায় বড় বড় ট্রলার নিয়ে সংঘবদ্ধ জেলেরা ইলিশ শিকার করেন। তারা আসলে কাউকেই ভয় পান না। এদের কাছে প্রশাসন অসহায়।
অভিযোগ রয়েছে, হিজলা উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হিজলা, ভোলা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও চাঁদপুরের জেলেদের নিয়ে অবৈধ চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রটি শিকার করা ইলিশ সন্ধ্যা ও ভোরে মেঘনা নদীর তীরে কয়েকটি এলাকায় নিলামে বিক্রি করে। এরপর শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর ও মাওয়া থেকে আসা পাইকাররা এসব কিনে স্পিডবোট ও ট্রলারে করে নিয়ে যায়।
মৎস্য বিভাগ জানায়, বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদের হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাট পয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার, হিজলার মেঘনার মৌলভীর হাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ-সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম। ২০১৯ সালে তৎকালীন সরকার দেশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে এলাকাটি গেজেটভুক্ত করে। এ সীমানার মধ্যে কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ, নয়ভাঙ্গুলী, গজারিয়া ও কীর্তনখোলা নদ-নদী আছে।
জেলে ও মাছ ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা জানান, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট, চাঁদপুরের হাইমচর এবং বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ সীমানার মেঘনার জানপুর এলাকাটি অবৈধ ইলিশ শিকারের মূলকেন্দ্র (হটস্পট) হয়ে উঠেছে। মূলত হিজলার জানপুর ঘিরেই এসব মাছ কেনাবেচা ও পাচার হয়। এলাকাটি দুর্গম এবং কয়েকটি জেলার মোহনা হওয়ায় এককভাবে কোনো জেলার প্রশাসন অভিযান চালাতে গেলে সীমানা জটিলতায় পড়ে। এই সুযোগ নিয়েই এসব এলাকায় অন্তত দুই হাজার জেলে বড় বড় ট্রলার নিয়ে দিন-রাত ইলিশ ধরছেন। এসব ট্রলারের প্রতিটিতে ১০ থেকে ১৫জন জেলে থাকেন। অভিযানকারী দল যাতে তাদের ধরতে না পারেন, সে জন্য এসব ট্রলারে দুই থেকে তিনটি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। তবে জেলেরা সংঘবদ্ধ হওয়ায় সহসা অভিযানকারী দল দেখে তারা পালান না। সংঘবদ্ধ হয়ে উল্টো তারা ইট ও পাথর ছুড়ে মারেন। সেই সঙ্গে প্রবল ঢেউ তৈরি করে বাঁশ, গজারির লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলাও চালান। লাঠির মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে পেট্রল দিয়ে আগুনের গোলস্না বানিয়ে অভিযান পরিচালনাকারীদের দিকে ছুড়ে মারেন।
আবুপুর, হরিনাথপুর, আশুলি আবুপুর এলাকার কয়েকজন জেলে জানান, প্রশাসন ম্যানেজ করার জন্য তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দেন। এসব নেতা ছোট নৌকা থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা নেন।
সুজন সরদার বরিশাল জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি। তিনি বলেন, 'আমি এসব ঘটনার ধারে কাছেও নেই। পুলিশ-প্রশাসন থেকে আমাকে ফোন করে এসব জানাতে চেয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আপনারা এলাকায় এসে সত্যতা যাচাই করুন। আমি অস্বীকার কবর না যে, এখানে আমাদের দলীয় লোকজন জড়িত নেই। তারা অনেকে আমার নাম বিক্রি করছে। এতে আমি বিব্রত।'
বিএনপি নেতা আবদুল গাফফার তালুকদার বলেন, 'আমার হিজলা এলাকায় কেউ অবৈধভাবে মাছ ধরে না। শরীয়তপুর, হাইমচর, হরিনাথপুর, আবুপুর, মেহেন্দীগঞ্জের কয়েক হাজার জেলে মাছ ধরে। এতে আমার কি করার আছে? আমরা এর মধ্যে নেই।'
জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, একটি বড় চক্র অবৈধভাবে ইলিশ শিকার করছে। চক্রটির অপতৎপরতা বন্ধে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশের সহায়তায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কাজ করছে। তবে অভিযান চালাতে গিয়ে গত কয়েক বছরের মতো এবারও জেলেদের হামলার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি উদ্বেগের। চক্রের কর্মকান্ড প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।