ফসল হারিয়ে বিপাকে কৃষক
অতিবর্ষায় নড়াইল, চাঁদপুর ও পূর্বধলায় কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা
প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
এবারের বর্ষা মৌসুমে কয়েক দফা ভারী বৃষ্টিতে নড়াইল, চাঁদপুর ও নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। জমিতে পানি জমে থাকায় পচে নষ্ট হয়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। তারা এ বিপদ কাটিয়ে উঠতে সরকারিভাবে সহয়োগিতা কামনা করেছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
নড়াইল প্রতিনিধি জানান, চলতি বছর সারাদেশের ন্যায় নড়াইলে কয়েক দফায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে জেলার অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। মৎস্য ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাজারো কৃষক। ভারী বৃষ্টিতে কৃষকদের ক্ষেতের সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে শুধু বৃষ্টিতে মৎস্য ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত নব্বই কোটি টাকা। আর কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত দশ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ছোট জেলা নড়াইলে কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত শতকোটি টাকা।
জানা গেছে, প্রায় আট লাখ মানুষের বসবাসের জেলা নড়াইল। বিল ও ঘেরবেষ্টিত এ জনপদের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষ। ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি এ জেলার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মৎস্য চাষে সরাসরি জড়িত।
নড়াইল শহরের ঘের ব্যবসায়ী কৃষক মো. আহাদউজ্জামান এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। পৌর এলাকার ভওয়াখালী বিলে তিনটি ঘের রয়েছে তার। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করে এ বছরও বিভিন্ন প্রকার মাছ চাষ করেছিলেন। টানা বৃষ্টিতে তার তিনটি ঘের তলিয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে ঘেরের পাড়ের বিভিন্ন প্রকার সবজি। ঘের আর বিল পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিক এই মৎস্য ব্যবসায়ী ছয় লাখ টাকা খরচ করেছেন, ভেবেছিলেন অন্তত দশ লাখ টাকা লাভ হবে। তবে তার সেই স্বপ্ন নিমেষেই বিলীন হয়ে গেছে। ধারদেনার টাকা কিভাবে শোধ করবেন সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এই মৎস্য ব্যবসায়ী।
কৃষক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার বিল ও ঘের অঞ্চলের প্রতিটা এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষকদের একই অবস্থা। চলতি মৌসুমের কয়েক দফা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে এলাকার রাস্তাঘাট, কৃষকদের ক্ষেতের ফসল, সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। আর এতে বিপাকে পড়েছে নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার হাজারো মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষক। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার মৎস্য চাষি ও প্রান্তিক কৃষকরা। ঘের ভেসে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
পৌর এলাকার দুর্গাপুর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী জিরু শেখ বলেন, দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘের ব্যবসা করেন। বৃষ্টিতে এত ক্ষতি কখনো হয়নি। সাড়ে তিন একর জমিতে দুটি ঘেরে যত মাছ ছিল সব চলে গেছে। অন্তত সাত লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তার।
একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আজিজুর শেখ বলেন, পাঁচটি ঘেরের মধ্যে চারটির মাছ চলে গেছে। ঘেরের পাড়ের সব সবজি নষ্ট হয়ে আট লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এক হাজার ৭শ' হেক্টর জমিতে মোট ঘের রয়েছে পাঁচ হাজার তিনশ'টি। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। এ অঞ্চলের ৬৬ শতাংশ ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঘের ব্যবসায়ী সাড়ে দশ হাজার। আর এ পেশায় জড়িত অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩৩ হাজার। শুধু মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৯০ কোটি টাকা।
এদিকে আমন ধান, ঘেরের পাড়ে শিম, কুমড়া, শসা, পেঁপেসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত দশ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অতিবৃষ্টিতে এ জনপদে ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকা।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশেক পারভেজ বলেন, ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের সরকারিভাবে বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হবে। তাহলেও তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
জেলা মৎস্য অফিসার এইচ এম বদরুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ঘের ব্যবসায়ীদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা ইউনিয়নের মিলারচর ও হানিরপাড় এলাকায় প্রায় সাড়ে ৪শ' হেক্টর জমিতে অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা।
জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এতে এসব জমিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। খাল সংস্কারের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিয়ে ফসল ফলানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।
সরেজমিন গিয়ে মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা ইউনিয়নের হানিরপাড়, মিলারচর ও দশানী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিনের অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ওই এলাকার প্রায় সাড়ে ৪শ' হেক্টর জমিতে কচুরিপানা ভরপুর ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে ওই এলাকার কৃষকরা আমন ধান রোপণ করতে পারেননি। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে মতলব উত্তর ইউএনও ও কৃষি কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছেন।
ইউএনও একি মিত্র চাকমা বলেন, মিলারচর এলাকার কৃষকদের পক্ষ থেকে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি নিষ্কাশনের জন্য আবেদন পেয়েছেন।
মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফয়সাল মোহাম্মদ আলী জানান, মিলারচর এলাকার কৃষকদের পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে আবেদন করেছে। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় কৃষকরা ৪৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপণ করতে পারেননি। ফলে তারা ১ হাজার ৮শ' মণ ধান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। ওই এলাকার খাল খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পত্র দিয়েছি।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মেদ সিদ্দিকী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, সেচ প্রকল্পে এবার অতিবৃষ্টির কারণে ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সেচের মাধ্যমে এসব এলাকা থেকে পানি সরানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পূর্বধলা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার পূর্বধলায় বন্যার পানি কমে গেছে। তবে পানি কমলেও রেখে গেছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে আমন ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া কাঁচা-আধাপাকা ঘর, বেড়িবাঁধ, সবজির ফসল ও ফিশারির ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় সব মিলিয়ে পূর্বধলা উপজেলায় ৩৯ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বন্যার পানি কমে গেলেও নিচু এলাকার পানি এখনো রয়ে গেছে। বন্যার পানিতে বিস্তর মাঠের রোপা আমন ফসল পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব পচে যাওয়া ধান গাছে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি দূষিত হয়ে মাছ মরে ভেসে যাচ্ছে। উপজেলার জারিয়া, উদুয়ার কান্দা, বাইঞ্জা, মেঘশিমুল, হোগলা এলাকায় দেখা গেছে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ফসলি মাঠগুলোতে পচা ধান গাছ পড়ে আছে। এসব পচা ধান গাছের দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাইঞ্জা গ্রামের এমদাদুল ইসলাম কামাল আকন্দ, হোগলা ইউনিয়নের ভরাকান্দা গ্রামের আব্দুল মজিদ, শিবপুর গ্রামের আশিকুল ইসলাম জানান- বন্যার পানিতে ব্যাপক ফসলি জমি তলিয়ে যায়। এখন পানি কমলেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে। ফসলগুলো পানির নিচে থাকায় সেগুলো পচে গেছে। এসব পচা ধান গাছ থেকে পানি দূষিত হয়ে মাছ মরে ভেসে উঠছে।
অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ধান গাছ বা যে কোনো আগাছা পচে গেলে অ্যামেনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। যার জন্য মাছ মারা যাচ্ছে। এ সময় সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি আরও জানান, বন্যায় উপজেলায় ৪৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস থেকে জানা গেছে, বন্যায় ৩২টি আধাপাকা ঘর ও ১৭০টি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া উপজেলার বেড়িবাঁধটি জারিয়া ইউনিয়নে নাটেরকোনা এলাকায় অতিরিক্ত পানির চাপে ভেঙে গেছে। এতে মানুষে চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় উপজেলার ২ হাজার ১০০ হেক্টর জমির আমন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ২৫ হেক্টর জমির সবজি ফসল নষ্ট হয়েছে। আমনে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং ৮১ লাখ টাকার সবজি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জুবায়ের হোসেন জানান, এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ক্ষতির বিবরণী উলেস্নখ করে ঊর্ধ্বতন মহলে পাঠানো হয়েছে।
ইউএনও খবিরুল আহসান জানান, সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে জেলা অফিসে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে জরুরিভিত্তিতে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধটি দ্রম্নত মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে।