বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীন চলা ঢাকার কেরানীগঞ্জে কোটি কোটি টাকার কাজ বন্ধ পড়ে আছে। কাজগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে, অন্যদিকে সড়ক, সেতু, কালভার্টের অসমাপ্ত অংশে নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এমনকি পাকা সেতু থাকার পরও মূল সড়কের যানজট এড়াতে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা মালবাহী গাড়িও চলছে ঝুঁকিপূর্ণ লোহার বেইলি সেতু দিয়ে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সংযোগ সড়ক না থাকাসহ নানা কারণে কোনো কাজেই আসছে না কেরানীগঞ্জের আটিবাজার, খাড়াকান্দি, মোলস্নাবাজার-সাপের চর, পূর্ব আকসাইল, ছাতির চর-তালেপুর, বলসতা, বেলনা বাবরকান্দি, ধর্মশুর-কামার্তা, নতুন সোনাকান্দা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, জগ্ননাথপুর-হযরতপুর সেতুসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সেতু। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বলছে, পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা ঠিকাদারদের চূড়ান্ত নোটিশ করা হলেও কাজে ফিরছেন না অনেকেই। এর ফলে তাদের চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তির পরিকল্পনা করছে সরকার।
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলার যোগাযোগ সহজ করতে সিরাজদিখান উপজেলা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা নদীর নদীর ওপর ২০১৮ সালে একটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। প্রায় ৭ বছর হয়ে গেলেও ২৫২ মিটার দীর্ঘ সেতুটির কাজ শেষ হয়নি। অথচ চার বছর আগেই সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ফলে সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলার পাঁচ-ছয় লাখ মানুষের এ সেতুতে ঢাকায় যাতায়াতের অপেক্ষা শেষ হয়নি। এ ছাড়া দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মোলস্নারহাট এলাকায় এ সেতু নির্মাণের কাজ পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এদিকে ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে জগন্নাথপুর-হযরতপুর সেতু। সংযোগ সড়ক না থাকায় ব্যবহার করতে পারছেন না এলাকাবাসী। যেখানে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে নেই সংযোগ সড়ক, তবে আছে বসতবাড়ি। এর অন্যতম কারণ জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ না করেই এ সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রায় আট মাস আগে শেষ হয়েছে এই সেতুর নির্মাণকাজ। তারপরও ঝুঁকিপূর্ণ লোহার সেতু দিয়েই পারাপার হচ্ছে মালবাহী গাড়ি। কারণ এখানেও নেই কোনো সংযোগ সড়ক। কিন্তু সেখানে এখনো পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন আব্দুল কাদের মোলস্না নামে এক ব্যক্তি।
তিনি অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের অভিযোগ করে জানান, 'আমার বসতবাড়ি জোরপূর্বক দখল করে সেতু নির্মাণ করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তারা হযরতপুর সেতুর জমি অধিগ্রহণের আশা দিয়েও কোনো মূল্যই পরিশোধ করেনি। নিজেদের পকেট ভরাতেই এমন অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের মহাযজ্ঞ ছিল অতীতের।'
একই চিত্র উপজেলা আটি বাজার সেতু থাকলেও সংযোগ সড়ক হয়নি এমন অভিযোগ করে নূরে আলম বলেন, 'আমি কাঠের সাঁকো দিয়ে পার হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। জীবনের এমন ঝুঁকি নিয়ে কাঠের সাঁকো ব্যবহার করতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। নাগরিক জীবনের এই বেহাল চিত্র বুড়িগঙ্গা ঘেঁষা কেরানীগঞ্জের আটি বাজার।'
সেতুর দুই পাড়ের স্থাপনা উচ্ছেদ করে সংযোগ সড়ক দ্রম্নত নির্মাণ করার দাবি করেন অনেকেই। কবে এ পাকা সেতু চালু হবে সে বিষয় তাদের অজানা। এমনই নানা কারণে কেরানীগঞ্জের গলার কাঁটায় রূপ নিয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক সেতু। অভিযোগ আছে, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ কর্তৃপক্ষের অবহেলায় নানা অজুহাতে কাজ শেষ না করেই প্রকল্প ফেলে রেখে ৫ আগস্ট, সটকে পড়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। নানাভাবে চেষ্টা করেও মেলেনি কারও বক্তব্য।
এ সময় গৃহিণী নওরিন সিদ্দিকী আফরা বলেন, জীবন সংসারে ভাগ্যের নির্মমতায় পা হারিয়ে ক্র্যাচে ভর করেই জীবন চলে তার। চোখের সামনেই তৈরি হওয়া একটি সেতু তিন বছরের বেশি সময় পড়ে থাকলেও, এর কোনো সুবিধাই পাননি আটিবাজার-ঘাটার চরের জনগণ। সেতুটি এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। কিন্তু সেতুটি হলেও সংযোগ সড়ক না থাকায় এখানকার কয়েক লাখ মানুষ কষ্ট করে সাঁকো দিয়ে চলাচল করছে। আমাদের দুর্ভোগ লেগেই আছে। দেখা কেউই নেই, আছে শুরু ঢাকঢোল পিটানোর বাজনা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, দেশে অনেক অপরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদের পরিকল্পনা দরকার। কিন্তু দেখা যায়, ভবিষ্যতের চিন্তা না করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের ফলে অনেক ক্ষেত্রে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দায়সারা কাজ করে অর্থ তুলে নিতে পারাই কেবল এসব প্রকল্পের লক্ষ্য। এ ছাড়া সমন্বয়হীনতার কারণে মাঝেমধ্যে এসব সেতুর কার্যকারিতাও হারায়।
ঢাকা সার্কেলের সড়ক ও জলপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার জটিলতার কারণে কেরানীগঞ্জের কয়েকটি সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে না পারায় সেতুটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অতিদ্রম্নত জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সংযোগ সড়কের কাজে হাতে দেওয়া যাবে।