সারাদেশের মোকামে ধান-চালের সিংহভাগ চাহিদা মেটায় উত্তরের জেলা নওগাঁ। আশির দশকে এ জেলায় গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় আঠোরোশ'র অধিক হাসকিং মিল। কালের বিবর্তনে মিলগুলোর এখন জীর্ণ দশা। অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জেলায় এ পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে অন্তত ৮২ শতাংশ চালকল। যার প্রভাবে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী নিয়েছে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। বেকার হয়েছেন অন্তত ৩৫ হাজার চাতাল শ্রমিক। এ সংকট কাটাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চালকল মালিক গ্রম্নপের নেতারা।
সম্প্রতি সরেজমিন শহরের আড়তদারপট্টি-সুলতানপুর সড়কে গেলে দেখা যায়, দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অন্তত ৬টি হাসকিং মিল বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শ্রমিকদের ব্যস্ততায় মুখর থাকা চালকলগুলোয় এখন সুনসান নীরবতা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় মিলগুলো ছেয়েছে আগাছায়। বিপরীতে মিলগুলোর পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রেখেছে অটোমেটিক রাইস মিল মালিকরা। দিন-রাত চলছে তাদের কার্যক্রম।
ওই এলাকায় পরিত্যক্ত এক হাসকিং মিলে পস্নাস্টিক কারখানা গড়ে তুলেছেন সদর উপজেলার পার নওগাঁ মহলস্নার সুমন সাহা। বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে ২০১১ সালে বাবার মালিকানাধীন ৩টি হাসকিং মিলের ব্যবসার হাল ধরেছিলেন। মুনাফা থাকায় ব্যবসাও চলছিল বেশ। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের পর অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হয় সুমন সাহাকে। পরে বাধ্য হয়ে দুটি হাসকিং মিল বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন।
সুমন সাহা বলেন, 'অটোমেটিক রাইস মিল মালিকরা ব্যবসা শুরুর পর থেকে ধান-চালের বাজারে তাদের একক আধিপত্য বিস্তার শুরু হতে থাকে। হাটে-বাজারে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ধান কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। ওরা যে দামেই ধান কিনুক না কেন, সেখান থেকে উৎপাদিত চাল বিক্রির সময় মোটা অংকের টাকা লাভ করতে পারে। বিপরীতে হাসকিং মিলে উৎপাদিত চাল দেখতে আকর্ষণীয় না হওয়ায় বেশি দামে ধান কিনে লাভ ছাড়া বিক্রি করতে গেলেও বাইরের মোকামের ব্যবসায়ীরা কিনতে চান না। এভাবে একটা পর্যায়ে নগদ টাকার সংকটে ঋণগ্রস্ত হয়ে ৩টি মিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।'
সুলতানপুর মহলস্নার চাতাল শ্রমিক রহিমা, আমেনা ও সুফিয়া বলেন, 'এক সময় সূর্যের আলো ওঠার আগেই দল বেঁধে চাতালে ছুটে আসতাম। খোলা কণ্ঠে গান গেয়ে পায়ে পা লাগিয়ে ধান শুকিয়েছি। পারিশ্রমিক হিসেবে চালসহ নগদ যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে সংসার ভালোই চলত। কিন্তু এখন আর সেই সোনালি দিন নেই। একের পর এক মিল বন্ধ হওয়ায় আমরা কাজের খোঁজে ছোটাছুটি করতে এখন প্রায় ক্লান্ত। অটোমেটিক রাইস মিলে নারীশ্রমিক নেয় না। বর্তমানে যে মিলে কাজ করছি সেখানে রোদ উঠলে তবেই পারিশ্রমিক পাই। আকাশ মেঘলা থাকলে না খেয়ে দিন পার করতে হয়।'
চাতাল শ্রমিকদের সংগঠন নওগাঁ জেলা ধান ও বয়লার অটো সর্টার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফফর হোসেন বলেন, অল্প শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণে চাল উৎপাদনে সক্ষম অটোমেটিক রাইস মিল। বিপরীতে হাসকিং মিলে চাল উৎপাদনে বেশি সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। তাই একের পর এক হাসকিং মিল বন্ধ হওয়ায় চাতাল শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা বর্তমানে চরম হুমকির মুখে পড়েছে। গত দেড় দশকে অন্তত ৩৫ হাজার চাতাল শ্রমিক বেকার হয়েছেন। মজুরি কম হওয়ায় কিছু শ্রমিক পেশা বদলেছেন। এখন যারা টিকে আছেন, তাদের বেশিরভাগই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটায়। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটাই চাওয়া 'শ্রমিকদের নায্য মজুরি দেওয়া হোক'।
খাদ্য বিভাগ ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় ৩৫৬টি সচল চালকল রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪টি অটোমেটিক রাইস মিল এবং ৩১২টি হাসকিং মিল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। গত ১ বছরে জেলায় বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদনে সক্ষম ধান উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে চালের চাহিদা রয়েছে মাত্র ৬ লাখ টন। বাকি ১১ লাখ টন চাল ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করেন জেলার চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি পর্যায়ের চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটোমেটিক রাইস মিলে উৎপাদিত পলিশকৃত চালে পুষ্টি গুণাগুণ কম হলেও ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদার শীর্ষে থাকে। জেলার বাইরের মোকামে সরবরাহ করা ১১ লাখ টন চালের মধ্যে অন্তত ৮ লাখ টন অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের থেকে নিতে হয়। তাই সারাবছর তারা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক হাসকিং মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সিন্ডিকেট ক্রমাগত আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রম্নপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, গত দেড় দশকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই জেলায় অসংখ্য অটোমেটিক রাইস মিল গড়ে উঠেছে। সরকার কখনো তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেনি। যার প্রভাবে ৮২ শতাংশ চালকল মালিক ব্যবসা থেকে শটকে পড়েছেন। হাসকিং মিলে উৎপাদিত চালের পুষ্টি গুণাগুণ জনগণের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি চাল পলিশ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ্যা নিলে তবেই হাসকিং মিলের জৌলুস আবারও ফিরে আসবে। এতে সহজেই চালের বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙবে। ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়লে ভোক্তা পর্যায়েও স্বস্তি ফিরে আসবে।