মেঘনা-সুগন্ধা ও বিষখালীতে ইলিশ নিধন উৎসব

৪৭ জেলে আটক

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

ঝালকাঠি ও চাঁদপুর প্রতিনিধি
গত ১৩ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ২২ দিনের জন্য ইলিশ নিধন, বিক্রি ও পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঝালকাঠিতে চলছে কিছুটা ব্যতিক্রম। খোদ মৎস্য অফিসের যোগসাজশে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনেক জেলেরা নদীতে মা ইলিশ নিধন অব্যাহত রেখেছে। এদের মধ্যে মৌসুমি জেলের সংখ্যাই বেশি। নিষেধাজ্ঞা শুরু থেকে গেল এক সপ্তাহে সরেজমিন অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় তাহলো শতাধিক মানুষ সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে লক্ষাধিক মিটার জাল নিয়ে পৃথকভাবে ইলিশ নিধনের মহোৎসবে মেতেছে। যা মধ্য রাতে দৃশ্যমান থাকে। অনেকে বলছেন অসাধুদের ইলিশ নিধনের বিষয়টির সঙ্গে জেলা মৎস্য অফিসও জড়িত। নিষেধাজ্ঞার সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কিছু জাল জব্দ এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুইজনকে কারাদন্ড দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো সাফল্য নেই মৎস্য অফিসের। তারা নামমাত্র অভিযান, ফটোসেশনসহ তাদের দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত। তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নলছিটির তেতুলবাড়িয়া এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিন থেকেই বিষখালী নদীর ভবানীপুর, ইসলামপুর, তেতুলবাড়িয়া লঞ্চঘাট ও সুগন্ধা নদীর মগড় জাঙ্গালিয়া ইটভাটা, অনুরাগ, দপদপিয়া, মাটিভাঙা এলাকায় চলছে অবাধে মা ইলিশ মাছ নিধন। অভিযানে নামার আগাম খবর পেয়ে যায় জেলেরা। এর পরই শুরু হয় মৎস্য দপ্তরের লোকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি গ্রামের জুয়েল হাওলাদার বলেন, শতাধিক ডিঙ্গি নৌকা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে নদীতে। মৎস্য অফিসের অভিযানের ট্রলার আসার আগেই এরা নৌকা নিয়ে ছোট ছোট খালে আত্মগোপনে চলে যায়। অভিযানের লোকরা চলে গেলে তারা আবার নৌকা নিয়ে নদীতে প্রবেশ করে। ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা নান্টু সেলিম বলেন, তালিকাভুক্ত (কার্ডধারী) অনেক জেলে নিজে নদীতে না নেমে মাছের ভাগের বিনিময়ে নৌকা ও জাল দিয়ে মৌসুমি জেলেদের সহযোগিতা করছেন। আবার এলাকার কিছু লোক নৌকা কিনে মৌসুমি জেলেদের কাছে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকায় ভাড়া দিচ্ছেন। আর মৎস্য অফিসের লোকজন সারাদিন নির্দিষ্ট একটি গন্ডির মধ্যে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিছু জাল ধরে ফটোসেশন করে চলে যায়। খেয়াঘাটে দায়িত্বরত অনেকে জানালেন, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট নদীতে অভিযানে নামলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলফোনে অসাধু জেলেদের খবর জানিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে বেশ কিছু লোক। বিনিময়ে প্রত্যেককে ৫০০-৬০০ টাকা করে প্রতিদিন দেওয়া হয়। এদের কাজ হলো নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং নদীতে প্রশাসন অভিযানে নামলেই মা ইলিশ নিধনকারী মৌসুমি জেলেদের সাবধান করে দেওয়া। কারণ মৎস্য কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তাদের হিমধরা আতঙ্ক। গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন জেলে জানান, বর্তমানে প্রচুর ইলিশ জালে উঠছে। দিনের চেয়ে রাতেই বেশি নিরাপদ। তাই রাতেই বেশি জাল ফেলছেন। ইলিশ বিক্রির জন্য কোনো চিন্তা করতে হয় না। ক্রেতারা নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন মাছ কেনার জন্য। কিছু ক্রেতা মোবাইলফোনে যোগাযোগ করেন। ফোন দিলেই তারা এসে মাছ নিয়ে যান। অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, 'যখন যেখানে জাল ফেলার সংবাদ পাচ্ছি তখনই সেখানে অভিযান চালাচ্ছি। আমরা যেভাবে গোপন খবর পেয়ে অভিযানে ছুটে যাই, ঠিক তেমনি আমাদের অভিযানের তথ্যটিও অসাধু জেলেদের কেউ খবর দিয়ে দেয়। তাই অনেক সময় ব্যাটে-বলে মেলে না। আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সঠিক নয়। আবার আমাদের ফোন করে ভুল তথ্যও দিচ্ছে অজ্ঞাত লোকজন। ভুল তথ্যের কারণে অভিযানেও ব্যাঘাত ঘটছে।' জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ৬৩ কিলোমিটার নদীর ৮ পয়েন্টে আমরা আলাদা নজর রাখছি। মৎস্য অফিসের অভিযান বা টহল টিম নির্ধারিত গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো এলাকায়ই টহল দেওয়া হচ্ছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।' চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা নদীর অভয়াশ্রম এলাকায় মা ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ধরায় পৃথক তিনটি অভিযান চালিয়েছে জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স। অভিযানে ৪৭ জেলেকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জেলেকে এক মাস করে কারাদন্ড, ২৪ জেলেকে বিভিন্ন অঙ্কে জরিমানা ও ১১ অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু জেলেকে মুচলেকা রেখে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। রোববার এসব তথ্য নিশ্চিত করেন অভিযানে অংশগ্রহণকারী চাঁদপুর সদর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত অভয়াশ্রম এলাকায় জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স পৃথক ৩টি অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। এসব অভিযানে নেতৃত্ব দেন মৎস্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান, চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাকারিয়া হোসেন। টাস্কফোর্সের এসব অভিযানে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশসহ মৎস্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সার্বিক সহযোগিতা করেন। তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা, সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল-ইমরান খান ও হাইমচর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিরুপম মজুমদার। এক মাস করে কারাদন্ডপ্রাপ্ত ১২ জেলে হলেন- মমিন আলী (৪৫), আল-আমিন সৈয়াল (৩২), শাহজালাল মাল (৬৩), হাসান খান (১৮), রাকিব হোসেন (১৮), মানিক (২২), রাজিব মাল (২৫), হৃদয় মজুমদার (১৯), রাকিব খান (২০), নয়ন (১৮), আরিফ শেখ (২৩), আল-আমিন (৩৫)। বিভিন্ন অঙ্কে জরিমানাপ্রাপ্ত ২৪ জেলে হলেন- শাহাবুদ্দিন (২৮), শিপন (২৮), আনসার খান (২৬), গিয়াস পাটওয়ারী (২৫), রিপন খান (২৪), হাসান গাজী (২০), আল-আমিন (২২), সরাফত গাজী (৩০), মাইনুদ্দিন ঢালী (৩০), শাহাদাত কাজী (৩০), আলমগীর গাজী (৪৫), জয়নাল বেপারী (৬৪), হৃদয় দেওয়ান (২০), ফরহাদ পাটওয়ারী (১৮), ফারুক মোলস্না (২৩), গোলাম রুসুল (৬৩), ওসমান গণি (৬০), রুবেল ঢালী (২২), ইব্রাহীম বেপারী (৬৮), সোলেমান বেপারী (৫৫), মিজানুর রহমান বেপারী (৬০), মো. কালু (৩০), পারভেজ (২২), মরণ বেপারী (৫২)। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেওয়া ১১ শিশু জেলে হলেন- রাকিব সামি (১৪), নয়ন সরদার (১৪), আবুল হোসেন (১৫), ইব্রাহীম (১৪), হৃদয় গাজী (১৪), বাবুল (১৫), ইউনুছ আলী (১১), সাইদুল (১২), ওসমান মোলস্না (১৩), রাজিব (১১) ও মোবারক (১৭)।