প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তাহিরপুর যেন বর্ষাকালে তার সমস্ত সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। আর সেই সৌন্দর্যের টানে হাওড় উপজেলা তাহিরপুরে টাঙ্গুয়া হাওড়, টাকেরঘাট পাথর কোয়ারী (নীলাদ্রী লেক), জাদুকাটা নদী, বারেক টিলা, লাকমা ছড়া, রাজাই ঝরনা, শিমুল বাগান, হাওলি জমিদার বাড়ি, বিকি বিলের লাল শাপলা দেখতে ভ্রমণপিপাসু লোকজন ছুটে আসেন বর্ষার শুরু থেকেই। হাউজ বোটে বসে বসে কিংবা বোটের জানালায় উপভোগ করেন দিগন্ত বিস্তৃত টাঙ্গুয়া হাওড়ের নীল জলরাশির সঙ্গে মেঘালয় পাহাড়ে মেঘের লুকোচুরির অপার সৌন্দর্য।
আবার হাওড়ের নয়নকাড়া সৌন্দর্যের টানে ঘুরতে এসে ঘটছে মৃতু্যর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও। সাঁতার না জানার কারণে পানিতে গোসল করতে নেমে গত ৫ বছরে ৭ জন পর্যটকের মর্মান্তিক মৃতু্য হয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে জনতা ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিসার (ঢাকা) টাঙ্গুয়া হাওড়ে গোসল করতে নেমে নদীতে নিখোঁজ হন। ৪ ঘণ্টা পর তাহিরপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল তাকে পানি থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে জাদুকাটা নদীতে গোসল করতে নেমে জাহিদ হাসান নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী মারা যান। ২০২১ সালে ৯ সেপ্টেম্বর ট্যাকেরঘাট পাথর কোয়ারী (নীলাদ্রী লেকে) গোসল করতে নেমে এমআইএসটির শিক্ষার্থী রাজীব আহমেদ মারা যায়। ২০২২ সালে ২৮ জুন টাঙ্গুয়া হাওড়ে গোসল করতে নেমে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার শেলবরস গ্রামের এক শিক্ষার্থী মারা যান। একই বছর ৫ আগস্ট ট্যাকেরঘাট পাথর কোয়ারীতে (নীলাদ্রী লেক) গোসল করতে নেমে ওয়াহিদ খলিল নামে ডেসকোর এক কর্মকর্তা মারা যান। সে বছরই ১৩ আগস্ট তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থী জাহেদ চেীধুরী ট্যাকেরঘাট রাতের বেলা নৌকায় ঘুমন্ত অবস্থায় পানিতে পরে যান। পরদিন পানি থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
২০২৩ সালে টাঙ্গুয়া হাওড় ঘুরতে এসে পার্শ্ববর্তী পালই হাওড়ে বিদু্যতের সঞ্চালন লাইনে জড়িয়ে কিশোরগঞ্জের জামরুল মিয়া নিহত হন। একই ঘটনায় আরও ৩ জন আহত হয়েছেন।
সর্বশেষ গত শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে টাঙ্গুয়া হাওড় ওয়াচ টাওয়ায় এলাকা ভ্রমণের সময় নৌকা থেকে লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই পানিতে ঝাঁপ দেন জনতা ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিসার (ঢাকা) আলী আহসান। তারপর থেকে তিনি ওয়াচ টাওয়ার পার্শ্বস্থ নদীতে নিখোঁজ হন। ৪ ঘণ্টা পর তাহিরপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি ডুবুরি দল টাঙ্গুয়া হাওড় পৌঁছে তাকে মৃত অবস্থায় পানি থেকে উদ্ধার করে।
গত ৫ বছরে তাহিরপুরে পর্যটকদের এমন মর্মন্তিক মৃতু্য শুধু অসাবধনাবশত হয়েছে। কেউ সাঁতার না যেনে পানিতে নামছেন। পানিতে নামলেও অনেকেই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করছেন না। নদী, লেক কিংবা হাওড়ে জলের গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নিচ্ছেন না। কিংবা ধারণা নিলেও আবেগাপস্নুত হয়ে হুটহাট পানিতে নেমে পড়ছেন।
তাহিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী হাসান উজ্জ্বল, সাইদুল কিবরিয়া, সোহানুর রহমান সোহাগসহ একাধিক লোকজন জানান, হাওড়বেষ্টিত উপজেলা তাহিরপুর। জাদুকাটা নদী, বারেকটিলা, টাঙ্গুয়া হাওড়, ট্যাকের ঘাট পাথর কোয়ারীসহ অনেক সুন্দর ও দর্শনীয় স্থান ভ্রমণপিপাসুদের টেনে আনছে হাওড়ে। এখানে এসে অনেক পর্যটক হাওড় দেখার পাশাপাশি সাঁতার না জেনেও নদী, হাওড় কিংবা লেকের জলে নেমে গোসল করছেন। সে সময় তারা নিরাপত্তার কথা একদম ভুলে যাচ্ছেন। ফলে সৌন্দর্য দেখতে এসে অনেকে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। যদি পর্যটকরা সতর্ক থাকেন, তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।
মেঘদূত হাউজ বোটের পরিচালক অনির্বাণ দাস বলেন, 'হাওড়ে আগত পর্যটকরা সাঁতার না জানার পরেও হুটহাট পানিতে নেমে পড়েন। আমরা তাদের আটকে রাখতে পারি না। অনেক সময় তাদের পানিতে নামতে বাধা দিলে আমাদের উপর কিছুটা বিরক্তি বোধ করেন। তবুও আমরা তাদের লাইফ জ্যাকেট নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম পানিতে গোসল করার পরামর্শ দেই। আমরা চাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাঙ্গুয়া হওড়, নীলাদ্রী লেক এবং জাদুকাটা নদীর দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোতো সতর্কতামূলক সাইন বোর্ড স্থাপন হোক। কারণ নৌকার মাঝি কিংবা পরিচালকদের কথা তাদের অনেকক্ষেত্রে বিশ্বাস হয় না।'
তাহিরপুর ফায়ার সার্ভিসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সোহেল আহমদ বলেন, সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে নামায় কয়েকজন পর্যটকের মৃতু্য হয়েছে। সেটা খুবই দুঃখজনক। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। তবে তাহিরপুর হাওড়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। পাশাপাশি পানিতে নামতে গেলে অবশ্যই যেন লাইফ জ্যাকেট পরে নেন সবাই।
তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ২০১৭ সালে অক্টোবর মাসে টাঙ্গুয়া হাওড়ে জোছনা উৎসবের পর ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় বাড়তে থাকে। এখন প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক তাহিরপুর ঘুরতে আসেন। এসে অনেকেই অসতর্কতা অবলম্বন করেন। সবাই একটু সাবধনতা অবলম্বন করলেই হাওড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃতু্যর ঘটনা কম হবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হাসেম বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওড় ও নীলাদ্রী লেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক সাইন বোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও পর্যটকরা এখানে ঘুরতে এসে সাঁতার না জেনেও পানিতে নেমে পড়ছেন। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া যেন কোনো পর্যটক পানিতে না নামতে পারেন সে বিষয়ে নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে পর্যটক সবাইকে আরও সচতেন হতে হবে। তাহলে হাওড়ে ঘুরতে এসে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটবে না।