ঘর ছেড়ে চলে গেছে অনেকে

ভালো নেই ঝালকাঠির আবাসনের বাসিন্দারা

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. নজরুল ইসলাম, ঝালকাঠি
দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বেহাল ঝালকাঠির উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পের বাড়িঘর -যাযাদি
সাড়ে চারশ' ঘরে আড়াই হাজারের অধিক মানুষের বসবাস। ৫০টি গভীর নলকূপ অকেজো। সব ক'টি বাথরুমের ভাঙা দরজা। নেই কোনও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। গোরস্তান না থাকায় মৃতু্যর পর লাশ দাফনের জন্য নিতে হয় ৫ কিলোমিটার দূরে পৌর গোরস্তান এবং শ্মশানে। বেহাল এই অবস্থায় পরিণত হয়েছে ঝালকাঠির উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প এলাকা। গৃহ নির্মাণের পর দেড়যুগের বেশি সময় পেড়িয়ে গেলেও সংস্কার না করায় অধিকাংশ ঘরই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব ঘরের টিনের চালাগুলো মরিচা পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চালার ছিদ্র দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ। গেলো বর্ষা মৌসুমে এখানকার বাসিন্দাদের কষ্টের কথা শোনার মতো ছিল না কেউ। বৃষ্টির পানিতে ভিজে যায় বিছানাসহ ঘরের মালামাল। এখানকার বেশির ভাগ শৌচাগার ও গোসলখানাগুলো ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়েছে বেশ ক'বছর আগেই। রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির, প্রবেশ পথের একটি ব্রিজ ভেঙে খালের উপর ঝুলছে দু'বছর ধরে। সবমিলিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এই আবাসনে বসবাসকারী ৪৫০ পরিবারের সদস্যরা। আবাসনের মানুষেরা সংবাদকর্মী পেয়ে তাদের নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৬ সালে ঝালকাঠি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৫ একর খাস জমিতে স্থাপন করা হয় উত্তর কিস্তাকাঠির এই আবাসন প্রকল্পটি। তিনটি ব্যারাকে নির্মাণ করা হয় ৪৫০টি ঘর, যা বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৫০ ভূমিহীন নিম্ন আয়ের পারিবারকে। ১৭ বছরেও সংস্কার না হওয়ায় আবাসনের ৪৫০টি পরিবার বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। টিনের চালা এবং বেড়ায় সৃষ্টি হওয়া ছিদ্র পলিথিন দিয়ে ঢেকে পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে বাসিন্দারা। চলতি বছর কয়েক ধাপে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় বসতঘরে পানি প্রবেশ ঠেকাতে না পেরে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলেও গেছে এখানকার অনেক পরিবার। আসছে শীত মৌসুমেও ঘরের বেড়া পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ঠান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে হবে অনেককে। এমনটাই জানালেন তারা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি দশটি পরিবারের জন্য দুটি শৌচাগার দুটি করে গোসলখানা রয়েছে এখানে। শৌচাগারগুলো এখন ব্যবহারের অযোগ্য। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ব্যারাকে কোন ড্রেন না থাকায় ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি যাচ্ছে এখানকার পুকুরে। আর দূষিত হচ্ছে গোটা পুকুরের পানি। এই পুকুরের পানি ব্যবহার করে বাসিন্দারা নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। দুই একজন স্বচ্ছল বাসিন্দা ঘর নিজেরা মেরামত করে বসবাস করলেও নিম্ন আয়ের অসহায় বাসিন্দারা সংস্কার না করেই দিনেরপর দিন কষ্টে কাটাচ্ছেন। দিনমজুর দেলোয়ার হোসেন মাঝী আবাসনের ৩নম্বর ব্যরাকের ২০নং ঘরে থাকেন। তিনি বলেন, 'বৃষ্টির দিনে মাঠের চেয়ে আমার ঘরে পানি বেশি ওঠে। চালে পলিথিন টাঙিয়েও বৃষ্টি ঠেকানো যায় না। আর শীতে তো জনমের কষ্ট। ভাঙা বেড়াদিয়ে হুহু করে ঠান্ডা ঢোকে। আঠাদিয়ে মোটা কাগজ বেড়ায় লাগিয়ে রাখি।' একই ব্যারাকের ১নং ঘরে থাকেন গৃহিণী সীমা আক্তার বলেন, 'বইষ্যা নামলে মোর ঘরের চালের যে কয় জায়গা দিয়া পানি পরে। হেই পানি ধরার লইগ্যা মোড় ঘরে হেতুডি হাড়ি পাতিলও নাই। পেত্তেক ঘরে ৩বান হইররা টিনের প্রয়োজন। খাওয়ার পনির সব কয়ডা কল নষ্ট। বাথরুমের দরজা না থাহার মতোন।' এ আবাসনের ৩ নম্বর ব্যারাকের ৬নং ঘরের বাসিন্দা রিনা বেগম বলেন, 'জরাজীর্ণ ঘরতো আছেই এছাড়া এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে নেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, নেই গোরস্তান। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আমাদের শহরে গিয়ে উঠতে হয়। আর ড্রেন না থাকায় পানি জমে থাকে। ডেঙ্গুর ভয়ে নিজেরা মহিলারা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে পানি সরানোর চেষ্টা করি।' এখানকার আলমগীর খান এবং ইসরাফিল সিকদার জানান, 'তিন নদীর মোহনায় আমাদের এই আবাসনের কাছাকাছি কোনো সাইক্লোন সেল্টার না থাকায় ঝড় বন্যার সময় আমরা অনেকেই শহরে চলে যাই। এই আবাসনের বর্তমান পরিবেশ গরু ঘরের চেয়েও খারাপ।' বাসিন্দারের দুর্দশা নিয়ে উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প সমবায় সমিতি-১ এর সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন বলেন, 'আমরা বিভিন্ন সময় আবাসনের এসব সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিগত সরকার বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন আবাসন ও ঘর নির্মাণ করলেও আমাদের এখানের তিন হাজার বাসিন্দাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখানে বসবাসকারীদের একটাই দাবি দ্রম্নত প্রতিটি ঘরের চালের টিন পরিবর্তন করে নতুন করে চালা তৈরি, শৌচাগার ও গোসলখানাগুলো সংস্কার এবং নষ্ট হয়ে থাকা সব ক'টি টিউবওয়েল মেরামত করে ব্যারাকগুলো বসবাসের উপযুক্ত করতে হবে।' সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, 'কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প অনেক পুরনো। সবকিছু নতুনভাবে নির্মাণ করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। গত ৬ বছর আগে সংস্কারের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘরপ্রতি দু'টি করে টিন লাগানো হয়েছিল। গৃহ বরাদ্দের পর ১৭ বছরের মধ্যে এই মেরামত খুবই নগন্ন।' ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, 'প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ নিরসনের জন্য যথাসাধ্য কাজ করা হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখব।'