বরেন্দ্রের বিলুপ্ত ধান ফেরানোর চেষ্টা
এক কৃষকের ক্ষেতেই চাষ হচ্ছে ১১৫ রকম ধান
প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আসাদুজ্জামান মিঠু, তানোর (রাজশাহী)
রঘুশাইল, হরিরাজ, সাগর ফেনা, লক্ষ্ণীকাজল, কালিটেপি, রত্না, স্বর্ণামাসুরী, নারকেল মুচি, রাধুনি পাগল, পাঙ্গাস, ঝিঙ্গাশাইল, কালজিরা, সুবাশ, বাঁশমতি, চিনি শঙ্কর, বাদশাভোগ, এক ধানে দুই চাল, জটাবাঁশ ফুল, বিন্নি।
পরিবেশ বান্ধব ও সুগন্ধি এসব ধানের নাম এখন আর অনেকের মনে নেই। নতুন প্রজন্ম তো দূরের কথা প্রবীণদের অনেকের মনের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে নামগুলো।
তবে এসব ধান অনেক যত্নে আগলে রেখেছেন কৃষক জাইদুর রহমান। এসব বিলুপ্ত হওয়া ধান নতুন করে ফিরিয়ে আনতে তার নানা উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে নিজের ক্ষেতে ১১৫ জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন তিনি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েকজন উদ্যোগী কৃষক তার দেওয়া ফ্রি বীজ নিয়ে চাষ করেছেন আরও ৩৫ প্রকার ধান। রাজশাহী জেলার বরেন্দ্র ভূমির তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের বাসিন্দা কৃষক জাইদুর রহমান। তিনি বলেন, এমন উদ্যোগী হওয়া বড় কৃতিত্ব তার বড় ভাই ইউসুফ মোলস্নার। ২০২২ সালে বড় ভাই ইউসুফ মোলস্না মারা যাওয়ার পর তার বীজভান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি।
আদর্শ কৃষক হিসেবে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন ইউসুফ মোলস্না। তার প্রচেষ্টায় বিলুপ্ত প্রায় ২৫০ এর বেশি ধানের বীজ তার বীজ ভান্ডারে সংরক্ষণে আছে।
এত রকম জাতের ধান একসঙ্গে চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে ইউসুফ মোলস্নার বীজ ভান্ডারই প্রথম স্থানে আছেন বলে দাবি করেছেন কৃষক জাইদুর রহমান ও কৃষি কর্মকর্তারা।
ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বিলুপ্ত ধানের বীজ দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণে আছে ইউসুফ মোলস্নার বরেন্দ্র বীজ ভান্ডারে। ২০১২ সাল থেকে রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরসহ সারাদেশে প্রায় ৩০০ কৃষককে তিনি এসব বীজ শর্তসাপেক্ষে সরবরাহ করেছেন। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকায় ১০০ এর বেশি ও রাজশাহী গবেষণাগারে প্রায় ৬৫ জাতের ধান বীজ সরবরাহ করেছেন।
সরবরাহ করা বীজের মধ্যে চলতি আমন মৌসুমে ১৫০ প্রকার ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে নিজের ক্ষেতে এবার ১১৫ প্রকার, একই উপজেলার ১০, বগুড়া জেলায় ১৫, নীলফামারী ১০, ঝিনাইদহে চাষ করছেন ১২ প্রকার ধান।
সম্প্রতি সরেজমিন দুবইল গ্রামে কৃষক জাইদুর রহমানের ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় এক একর জমিতে ১১৫ প্রকার ধান চাষাবাদ করেছেন। একশ' বা হাফ শতক করে একেক প্রকার ধান চাষ করা হয়েছে। প্রতি ক্ষেতে আলাদা করে ধানের নাম দিয়ে সাইনবোর্ড দেওয়া আছে।
জাইদুর রহমান জানান, পরিবেশ বান্ধব সুগন্ধি এসব ধান অল্পদিনেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে গত ২৫ বছর আগ থেকে বীজ সংগ্রহের কাজ করছিলেন বড় ভাই ইউসুফ মোলস্না। এখন পর্যন্ত ২৬০ এর বেশি বিভিন্ন জাতের ধান বীজ সংগ্রহ করেছেন। ২০১২ সাল থেকে ৫০টি করে জাতের ধান তিনি অল্প করে আবাদ করেন। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী কৃষকদের বিতরণ করছেন।
জাইদুর রহমান আরও জানান, যেসব কৃষককে এসব হারানো ধানের বীজ সরবরাহ করছেন তা শর্তসাপেক্ষে। তা হলো বীজের বদলে বীজ। একজন কৃষক তার কাছে ৫ কেজি বীজ নিলে ধান উৎপাদনের পরে সে আবার ৫ কেজি বীজ ফেরত দেবে। এছাড়া সংগ্রহে থাকা ১০০ প্রজাতির বেশি বীজ গাজীপুর ধান গবেষণা কেন্দ্র ও রাজশাহী ধান গবেষণা কেন্দ্রে ৬৫ রকম বীজ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে ৭২, ঝিনাইদহ ১২ প্রকারসহ দেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব জাতের ধান সরবরাহ করেছেন। তারা সেগুলোর বিস্তার করা নিয়ে গবেষণা করছে। বিলুপ্ত বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগে উৎসাহ জোগাচ্ছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আর আর্থিকসহ সার্বিক সহযোগিতা করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিক।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিকের কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত সরকার বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে যেসব বস্তু দ্রম্নত বিলুপ্ত বা হারিয়ে যাচ্ছে সেসব নিয়ে গবেষণা করেন। এগুলো কীভাবে ধরে রাখা যায় সে বিষয়ে কাজ করে থাকেন তিনি। উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো নতুন প্রজন্ম যেন চিনতে পারে ও বুঝতে পারে।
এ ধারাবাহিকতায় তানোরের দুবইল গ্রামের কৃষক ইউসুফ মোলস্না ২০১০ সাল থেকে বিলুপ্ত বীজ সংগ্রহের বিষয়ে আর্থিকসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছে বারসিককে।
অমৃত সরকার বলেন, ২০২২ সালে কৃষক ইউসুফ মোলস্নার মৃতু্যর পর তার বীজ সংগ্রহের কাজ যেন বন্ধ না হয়ে যায় সে জন্য তার ছোট ভাই কৃষক জাইদুর রহমানকে উদ্যোগী করা হয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে বারসিকের আর্থিক সহযোগিতায় এক একর জমি লিজ নিয়ে জাইদুর রহমানকে দেওয়া হয়। এতে ১১৫ রকম জাতের ধান চাষ হয়েছে।
তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুলস্নাহ আহম্মেদ বলেন, কৃষক ইউসুফ মোলস্নার ২৫ বছরের প্রচেষ্টায় বরেন্দ্র থেকে অনেক নামিদামি বিলুপ্ত ধান নতুন করে জীবন পেয়েছেন। সে সঙ্গে দেশের মধ্যে তানোর উপজেলার কৃষক হিসেবে ইউসুফ মোলস্না রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের সুনাম ধরে রেখেছেন। এখন ইউসুফ মোলস্নার মৃতু্যর পরে তার ভাই কৃষক জাইদুর রহমান বীজ সংগ্রহের কাজ এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছেন। তাতে বিলুপ্ত ধান সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম আরও জানতে পারবেন। এজন্য তাকে কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।