ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন বিভিন্ন এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ সব জনপ্রতিনিধিরা। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। জরুরি প্রয়োজনে সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরই ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ১২ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছেন না। একাধিক ইউপি সচিব জানান, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মোবাইলফোন বন্ধ পাওয়ায় তাদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
জিনজিরা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব মোতালেব হোসেন জানান, 'গত কয়েক দিন আগে বিএনপি'র তিন শতাধিক লোক ইউনিয়ন পরিষদে এসে আমাকে ধমক দিয়ে গেছে, 'কোনো মেম্বার পরিষদে আসলে তাদের বের করে দেবেন।' এতে করে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি এবং চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।' এদিকে, চেয়ারম্যান মেম্বারের অনুপস্থিতির অজুহাতে সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা তাদের মনমতো পরিষদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এ কারণে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা গ্রহণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
কেরানীগঞ্জ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আলআমিন মিনহাজ বলছেন, যারা নানা অপকর্মের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে, মানুষকে শাসকের রূপে শোষণ করেছে তারাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেবা প্রত্যাশী মরিয়ম পারভীন, খাদিজাতুল হাসনা ও করিম মাদবরসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষ তালাবদ্ধ পাওয়া যাচ্ছে। উপজেলার বেশকিছু ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে একই চিত্র চোখে পড়েছে। তবে কিছু ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তারা উপস্থিত থাকলেও চেয়ারম্যান, মেম্বারের স্বাক্ষরের জন্য সেবা নিতে আসা লোকজনকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে জন্ম নিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও ট্রেড লাইসেন্স নিতে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, পরিষদে এসে অপেক্ষা করছেন কিন্তু চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা আসছেন না। স্থানীয় জনসাধারণ অভিযোগ করে বলেন, শুভাঢ্যা, জিনজিরা, রোহিতপুর, বাস্তা, শাক্তাসহ ১২টি ইউনিয়ন পরিষদে এই চিত্র প্রতিদিনের, আগেও ছিল। লোকজন প্রতিদিন কাজের জন্য এসে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অপেক্ষা করেন। কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদে দুপুরের আগে আসেন না সচিবরা।
তবে কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে সেবা প্রতাশীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দেবেন তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়া সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জানান, 'চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনুপস্থিতির বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত আকারে জানানো হয়েছে। বর্তমানে আটজন চেয়ারম্যান, (হযরতপুর, বাস্তা, তারানগর প্যানেল চেয়ারম্যান ও তেঘরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান) একজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও একজন নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করছি। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাপাত্তা। এতে করে পরিষদের কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন জনসাধারণ। তবে আত্মগোপনে থাকা ৪টি পরিষদের সচিবদের দাবি চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত থাকায় পরিষদের কার্যক্রম চলামান রাখতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। জরুরি কাগজপত্রের স্বাক্ষরসহ জরুরি কাজে প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা সমাধান করা হচ্ছে। এতে কিছুটা হলেও সেবা পাচ্ছেন জনসাধারণ। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ পরিষদে চেয়ারম্যান না আসায় ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।
জানা যায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর থেকে উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চলে যান আত্মগোপনে। তারা হলেন, উপজেলার সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি, ভায়ালক্ষীপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ প্রামাণিক ও সরদহ ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাসানুজ্জামাস মধু এবং শলুয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। অভিযোগ রয়েছে এই চারজন ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও চারঘাট-বাঘার এমপি শাহরিয়ার আলমের একান্ত আস্থাভাজন। ফলে শাহরিয়ার আলমের পাশাপাশি তারাও রয়েছেন আত্মগোপনে। জনরোষের হাত থেকে বাঁচতে তারা আত্মগোপনে আছেন বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতারা। আর আত্মগোপনে থাকায় ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। জরুরি ভিত্তিতে জন্ম নিবন্ধন, নগরিকত্বসহ বিভিন্ন কাজে পরিষদে গিয়ে দেখা মিলছে না চেয়ারম্যানদের। এতে জনসাধারণের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ দিকে পরিষদে না আসায় দুটি পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও দুটি পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে পরিষদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে দাবি পরিষদের সচিবদের।
চারঘাট সদর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব রাফি আহমেদ বলেন, 'পরিষদের চেয়ারম্যান না থাকলে একটু জটিলতা হবেই। তবে চারঘাট সদর ইউপিতে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন। জরুরি প্রয়োজনে ভূমি অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে পরিষদের কার্যক্রম চলমান রাখছি।'
ইউএনও সানজিদা সুলতানা বলেন, 'পরিষদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রাখতে দুটি পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও দুটি পরিষদ আমি এবং এসিল্যান্ড দায়িত্ব পালন করছি।'
মদন (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার মদন উপজেলার ৫ ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন আত্মগোপনে। প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের অনেকেই এখনো কার্যালয়ে ফেরেননি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের সেবা প্রার্থীরা। চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে শূন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে কাইটাল, মদন, নায়েকপুর, মাঘান, গোবিন্দশ্রী এ ৫টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থিত। তবে, নায়েকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাসপেন্ড থাকায় গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তার দায়িত্ব পালন করছেন ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি প্যানেল চেয়ারম্যান হাদিস মিয়া। তিনিও পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচটি ইউনিয়নেরই অনেক ইউপি সদস্যও রয়েছেন আত্মগোপনে। সেই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে অনেকের মোবাইল ফোন। জনপ্রতিনিধিরা পরিষদে না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া বিভিন্ন সনদ ও জন্ম-মৃতু্য নিবন্ধনের মতো নাগরিক সেবা কার্যক্রম।
উপজেলার কাইটাইল ইউনিয়নের বাশরী গ্রামের বাসিন্দা রহমত মিয়া জানান, মৃতু্য নিবন্ধনের জন্য ইউপি কার্যালয়ে যান তিনি। পরিষদ থেকে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করলেও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর প্রয়োজন। চেয়ারম্যান কার্যালয়ে না থাকায় তার স্বাক্ষর নেওয়া সম্ভব হয়নি। জনদুর্ভোগ নিরসনে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।
ইউএনও শাহ আলম মিয়া বলেন, 'পাঁচ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির বিষয়ে ইউপি সচিবরা চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত দেখিয়ে আমার কাছে তথ্য পাঠিয়েছেন। উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভা ও আইনশৃঙ্খলা সভার উপস্থিতির আলোকে তথ্য পাঠানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।