ঠাকুরগাঁওয়ে শীত জেঁকে বসার আগে একটি জনপদ গায়ে কাদা মাখামাখি করে প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে। সদর উপজেলার দুই ইউনিয়নের আকচা ও চিলারংয়ে অবস্থিত শুক নদীর বুড়ির বাঁধে এই হেমন্তে চলে মাছ ধরার উৎসব। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে মাছ শিকারিদের মধ্যে।
শীতের শুরুতে বুড়ির বাঁধের মাছ ধরা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে এ সময়টাই চলে আসছে বুড়ির বাঁধ এলাকায় মাছ ধরার উৎসব। হাজারো মানুষের ভিড়ে একটা মেলা বসে সেখানে তিন দিনের জন্য। সোমবার বিকালে সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের বুড়ির বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়। পরে পানি কমলে মঙ্গলবার থেকে মাছ ধরতে নামেন কয়েক গ্রামের শতাধিক জেলেসহ সাধারণ মানুষ। বুধবারও এ মাছ ধরা উৎসব চলে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাছ ধরার জন্য গ্রাম ও শহরের শত শত মানুষ আকচা ও চিলারংয়ে অবস্থিত শুক নদীর বুড়ির বাঁধে আসেন। নারী-পুরুষ ও শিশুসহ বৃদ্ধরাও রয়েছেন এ দলে। সবাই জাল, পলো, খোচা ও লাফিজাল নিয়ে নেমে পড়েছেন। এছাড়া যাদের মাছ ধরার সরঞ্জাম নেই তারাও হাত দিয়ে মাছ ধরতে নেমে গেছেন কাদার মধ্যে। সব মিলিয়ে এখানে এখন চলছে মাছ ধরার ধুম।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮২ সালে শুকনা মৌসুমে এই এলাকার জমি চাষাবাদের জন্য ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ও চিলারং ইউনিয়নের মাঝামাঝি এলাকায় শুক নদীর বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানি আটকে রাখা হয় ওই এলাকার উঁচু জমি চাষাবাদ করার জন্য। আটকে রাখা পানিতে প্রতি বছরে ঠাকুরগাঁও মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করে। আর শীতের শুরুতেই বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার পর মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতি বছর চলে বুড়ির বাঁধে মাছ ধরার উৎসব। মাছ শিকারিরা ফিকা জাল, লাফি জাল, কারেন্ট জাল, চটকা জালসহ বিভিন্ন মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে বুড়ির বাঁধে আসেন মাছ শিকার করার জন্য।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গৌরিপুর থেকে আসা জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'প্রতিবছর বুড়ির বাঁধে মাছ ধরার জন্য এ দিনটির অপেক্ষায় থাকি। মঙ্গলবার বিকালে গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পানি বেশি থাকায় মঙ্গলবার থেকে মাছ মারা শুরু হয়েছে।'
হরিপুরের আমবাড়ি থেকে মাছ ধরতে আসা শাহ আলম বলেন, 'মাছ ধরার জন্য আমরা ৫ জন খুব ভোরে এসেছি। বুড়ির বাঁধে মাছ ধরতে এসে মনে হচ্ছে, যেন বিরাট এক মেলা, যেদিকে চোখ শুধু মানুষ আর মানুষ। কিন্তু মাছ ধরতে এসে মাছ পাচ্ছি না। কারণ, স্থানীয় কিছু লোকজন চতুর্দিকে রিং জাল ও কারেন্ট জাল বসিয়ে মাছগুলোকে আটকে রাখে। এভাবে তারা যার যে জায়গা সেই জায়গাগুলো দখল করে রাখেন পরে পানি কমলে তারা মাছগুলো মারেন।'
মাছ শিকারি ছাড়াও মেলার ভিড় বাড়ায় মাছের ক্রেতারা। শহরের মাছ ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশি মাছ সস্তায় পাওয়ার লোভে শহর থেকে এই মাছ কিনতে আসা। কিন্তু এসে দেখা যাচ্ছে শহরের চাইতে এখানকার মাছের দাম বেশি।
ভুলস্নী থেকে মাছ কিনতে আসা শাহজাহান বলেন, এখানে টেংরা, গোচি, শিং, টুনা মাছ প্রতি কেজি ১০০০-১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর শোল ও রুই কাতল মাছ চাওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬শ' টাকা। প্রতি কেজি পুঁটি মাছ ৩০০-৪০০ টাকা।
শহরের বসিরপাড়া থেকে আসা সৌখিন মাছ শিকারি আব্দুল মান্নান বলেন, 'কি মাছ পেলাম সেটা বড় কথা নয়। সারা বছর অপেক্ষা করি এই বুড়ির বাঁধে মাছ ধরতে আসার এ সময়টার জন্য। গ্রামের মেলায় যেন এসেছি, এমন আনন্দ পাই!'
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সারোয়ার চৌধুরী জানান, বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার পর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় বুড়ির বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়। এতে উজানের পানি কমে যায়। আর শীতের শুরুতেই বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার পর মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিবছর চলে বুড়ির বাঁধে শত শত মানুষের মিলনমেলা ও মাছ ধরার উৎসব।