পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলের স্কুলগুলোয় অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, বিদ্যালয়গুলোর সঠিক তদারকির অভাব এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষকদের অভিযোগ, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময় অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ফলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই স্বল্প বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে শিক্ষকদের জন্য সুবিধা ও সুযোগ কম হওয়ায় তরুণরা এই পেশায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
জানা গেছে, রাঙামাটির প্রায় প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে শিক্ষক সংকট। বিশেষ করে লংগদু উপজেলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ। এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। উপজেলার মোট ৭৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ১১৯টি পদ শূন্য রয়েছে। যার মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২৭টি এবং সহকারী শিক্ষকের ৯২টি পদ রয়েছে। শিক্ষকের এই বিশাল সংকটের ফলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দুর্গম এই উপজেলার শিশুরা এমনটাই জানান স্থানীয় অভিভাবকরা।
লংগদু উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট ৭৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যালয়গুলোয় ৭৪ জন প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৩৭৩টি। মোট ৪৪৭টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষক আছেন ৩২৮ জন। যাদের মধ্যে ৪৭ জন প্রধান শিক্ষক এবং ২৮১ জন সহকারী শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি এবং সহকারী শিক্ষক নিয়োগে আইনি জটিলতার কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান শিক্ষক সমিতির নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষক সংকটে থাকা বিদ্যালয়ের মধ্যে উপজেলার বগাচতর ইউনিয়নের উগলছড়ি মহাজনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদ তিনটি, মারিশ্যারচর মুসলিমবস্নক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদসহ তিনটি, বগাচতর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ চারজন শিক্ষকের পদ শূন্য দীর্ঘদিন। পেটান্যামাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও প্রধান শিক্ষক ও সহকারী মিলে তিনটি পদ খালি। দক্ষিণ মারিশ্যারচর বিদ্যালয়ে চারটিই খালি। প্রধান শিক্ষক নাই দীর্ঘদিন। ঠেকাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ তিনটি পদ শূন্য।
উপজেলার ভাসান্যাদম ইউনিয়নের চাইল্যাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক আছেন মাত্র দু'জন। এই বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৯টি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে ২৬০ জন। তবে স্থানীয় অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সহায়তায় চার-পাঁচজন প্যারা শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।
এ ছাড়া ভাসান্যাদম ইউনিয়নের ঘনমোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের শূন্যপদ আছে ৪টি। এদিকে উপজেলার আটারকছড়া ইউনিয়নের ইয়ারিংছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনটি সহকারী শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন শূন্য। ভাঙ্গামুড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ শূন্য পদ রয়েছে তিনটি। আটারকছড়ার দুর্গম লেমুছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ ৩টি পদ শূন্য রয়েছে।
এ ছাড়া কালাপাকুজ্যা, ইসলামপুর, রশিদপুর ও গোলটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়জন করে শিক্ষকের অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন চারজন করে শিক্ষক। এদের মধ্যে কালাপাকুজ্যা ও রশিদপুর বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই দীর্ঘদিন।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। মাত্র দু-তিনজন শিক্ষক দিয়ে একটা স্কুল চালানো সম্ভব নয়। দু-তিনজন করে শিক্ষক দিয়ে কোনোভাবেই পাঁচ-ছয়টি শ্রেণিতে পাঠদান করানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই অনেক প্রতিষ্ঠানে কমিটি ও অভিভাবকদের সাহায্য নিয়ে প্যারা শিক্ষক দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে অতিদ্রম্নত এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ করতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
লংগদু সরকারি মডেল কলেজের প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায়, মূলত এই শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যাবে শিশুরা। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত না হলে পরবর্তী শিক্ষা অর্জনের ধাপগুলোতে উন্নতিকরা কষ্টসাধ্য হবে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির দূরবর্তী একটি উপজেলা লংগদু। এখানে এতো শিক্ষক সংকট নিয়ে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন দুরূহ।
এবারের শিক্ষা পদক-২৪ এ উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হওয়া রাঙ্গীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিক্ষক স্বল্পতা দূর করে সঙ্গে অফিস সহকারী, দপ্তরী, আয়া ও নৈশপ্রহরী নিয়োগ দেওয়া। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করা এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মনোনয়নে শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া। তবেই আশা করা যায় প্রাথমিক শিক্ষার এ দুরবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে।
প্রধান শিক্ষক সমিতির লংগদু উপজেলা কমিটির সভাপতি সুনীতি চাকমা জানান, শিক্ষকদের ডেপুটেশন বদলি প্রথা বাতিল করতে হবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার সফল বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত যেসব বিদ্যালয়ে সাতজনের অতিরিক্ত শিক্ষক আছে সেখান থেকে কম শিক্ষক থাকা বিদ্যালয়ে পদ সমন্বয় করা প্রয়োজন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এমকে ইমাম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া এবং সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির ধীরগতির কারণে এখানে শিক্ষকের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন হলো বিদ্যালয়গুলোয় দপ্তরি কাম প্রহরী নিয়োগও বন্ধ রয়েছে। ফলে লংগদু উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষায় এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে স্থগিত থাকা শিক্ষক নিয়োগটি সম্পন্ন হলে নতুন শিক্ষকদের আগমনে এ সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।