পানিবন্দি অর্ধলক্ষাধিক মানুষ
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় কেশবপুরের ১০৪ গ্রামে জলাবদ্ধতা
প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
কেশবপুর (যশোর) প্রতিনিধি
গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি না হলেও হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদীর পানিতে পৌর শহরসহ শতাধিক গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদী পলিতে ভরাটের পাশাপাশি ব্রিজ, কালভার্টের মুখ বন্ধ করে অপরিকল্পিত মাছের ঘের করার কারণেই এই স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
এদিকে, 'পানি সরাও মানুষ বাঁচাও' দাবিতে স্থানীয়রা মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। শহরের পাইকারি ও খুচরা সবজি বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা এই বাজার সরিয়ে শহরের মাইকেল গেট এলাকায় নিয়েছে। এ ছাড়াও, পানিতে তলিয়ে গেছে শহরের ধানহাটা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়, কেশবপুর থানা, গমপট্টি, পশুহাটা, কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ, মহিলা ফাজিল মাদ্রাসাসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঁজিয়া সড়ক, মধুসড়ক, গমপট্টি সড়ক ও গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।
সবকিছু পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ পড়েছে মহাবিপাকে। বানভাসি ২০০ পরিবার রাস্তার ওপর পলিথিনের টংঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় আমন ক্ষেত, সবজি ক্ষেত ও বেড়িবাঁধ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি গত তিনদিন ধরে জলাবদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করলেও এখনো পানি নিষ্কাশনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে বানভাসিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা গেছে, কেশবপুর পৌরসভার আট ইউনিয়নের পানি বুড়িভদ্রা, হরিহর হয়ে শ্রীনদী দিয়ে সাগরে নিষ্কাশন হয়। ২০১৯ সালে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে হরিহর, বুড়িভদ্রা ও আপারভদ্রা নদী খনন করা হলেও তা জনগণের কল্যাণে আসেনি। খননের দুই বছর যেতে না যেতেই নদীগুলো আবারও পলিতে ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে গত চার দিনের ভারী বর্ষণে আপারভদ্রা নদীতে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পৌরসভাসহ সদর ইউনিয়ন, মজিদপুর, বিদ্যানন্দকাটি, মঙ্গলকোট, পাঁজিয়া, সুফলাকাটি, গৌরিঘোনা ও হাসানপুর ইউনিয়নের ১০৪ গ্রাম পানিতে তলিয়ে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাসিন্দাদের যাতায়াতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
পাইকারি কাঁচা বাজার আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মশিয়ার রহমান বলেন, এক মাস ধরে বাজার তলিয়ে রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসেবে মাইকেল গেটের সামনে বাজার বসানো হয়েছে। তার সমিতির পক্ষে ২৩ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধরনের সবজি, আলু বানভাসিদের ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। '২৭ বিল বাঁচাও' আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক বাবর আলী গোলদার বলেন, কেশবপুরে ঘের নীতিমালা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে সরকারি খাল দখলে নিয়ে সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘেরই ব্রিজ, কালভার্টের মুখ বন্ধ করে করার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব ঘেরে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ভরাট করলেও প্রশাসন থাকে নির্বিকার। এরপরও আপারভদ্রা নদী সম্পূর্ণ পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। যে কারণে যৎসামান্য বৃষ্টিতেই হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পস্নাবিত হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য অফিসার সজিব সাহা জানান, ৪৬৫৮ মাছের ঘেরের মধ্যে ৩৬৪০টি ও ৬৬৪০টি পুকুরের মধ্যে ২৪২০টি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে দুই হাজার ১৫ মেট্রিক টন সাদা মাছ ও ৮-১০ মেট্রিক টন চিংড়ি মাছ ভেসে যাওয়ায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর আমনের আবাদ হয় ৯৫০৯ হেক্টর। এর মধ্যে ১৮৩০ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি ৬০০ হেক্টর আবাদ হলেও তলিয়ে যায় ২৩৯ হেক্টর। পান, তুলা, মরিচ ও ৬০ হেক্টর জমির তরমুজ ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস জানায়, উপজেলার ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩০টি মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বানভাসিরা যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের মধ্যকুল, ধোপাপাড়া মোড় ও কেশবপুর সরকারি পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে কেশবপুর পৌরবাড়ি মালিক সমিতির পক্ষে শহরের ত্রিমোহিনী মোড়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। মানববন্ধন থেকে দ্রম্নত পানি নিষ্কাশনসহ দ্রম্নত নদী খননের দাবি জানানো হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন সিকদার জানান, গত তিন দিন ধরে তার দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হরিহর, বুড়িভদ্রা ও আপারভদ্রা নদীসহ বন্যা পস্নাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আপাতত নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে অচিরেই এই সমস্যার নিরসন করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকির হোসেন বলেন, শিগগিরই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে বানভাসিদের সরকারিভাবে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।