জনবল সংকটে ধুঁকছে ২৫০ শয্যার হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল

চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় ৫৭ চিকিৎসকের মধ্যে ৩৫ জনই নেই ১৮ বিশেষজ্ঞের জায়গায় কর্মরত ৫

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালের ৫ম তলায় ৫০ জন ধারণক্ষমতার শিশু ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ৩শ' জন। সকাল থেকে এসব রোগীর সেবা করে মেডিকেল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাশ হিমশিম খাচ্ছিলেন। এ চিত্র মঙ্গলবার দুপুরের। শিশু ওয়ার্ডে এভাবে এক মাস ধরেই রোজ তিনশ' বা তার বেশি রোগী হয়। ৬ অক্টোবর ছিল ২৪৭ জন। একমাত্র জুনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু) ডা. ঊর্মি আচার্যের ওপর এ ওয়ার্ডের দায়িত্ব। তিনি সাপ্তাহে ২ দিন ডিউটি করেন। বাকি ৫ দিন তিনি আসেন না। একমাত্র সিনিয়র কনসালট্যান্টের (শিশু) পদটিও শন্য। ফলে ডা. দেবাশীষ দাশ অন্য ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পরও শিশু ওয়ার্ডে এসে রাউন্ড দেন। হাসপাতালের এক চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, 'জেলা সদর হাসপাতালে যে পরিমাণ শিশু রোগী ভর্তি হয়, ৫ জন কনসালট্যান্ট থাকলেও সেবা দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। শুধু জুনিয়র কনসালট্যান্টের দ্বারা এত রোগীর সেবা দেওয়া দুঃসাধ্য। কোনো রকম চলছে, তবে ভর্তি রোগীর চিকিৎসায় জটিলতা দেখা দেয়; অনেককে সিলেটে রেফার করতে হয়।' পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশু ওয়ার্ডের মতো হাসপাতালের প্রত্যেকটি বিভাগ একইভাবে চিকিৎসক সংকটে ধুঁকছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ২২টি পদের বিপরীতে মাত্র ৪ জন কর্মরত আছেন। বাকি ১৮টি পদ শূন্য। সিনিয়র কনসালট্যান্ট ১০টি পদের বিপরীতে মাত্র একজন ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১২ জনের বিপরীতে ৩ জন ডাক্তার আছেন। চিকিৎসক সংকটে গাইনি, শিশু, মেডিসিন পুরুষ ও মহিলাসহ সব ক'টি বিভাগে রোগীসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১৮টি পদ শূন্য থাকায় ভর্তি রোগীর চিকিৎসা দিতে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আমিনুল হক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, সেখানে গাইনি, ইএনটি, কার্ডিওলজি, ইউরোলজি, নেফরোলজি, সার্জারি, অর্থোসার্জারি, চর্ম-যৌন ও চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্টের একমাত্র পদগুলোতে একজনও চিকিৎসক নেই। একইভাবে রেডিওলজিস্ট, অর্থোসার্জারি, প্যাথলজি, মেডিসিন, গাইনি, কার্ডিওলজি, মানসিক, গ্যাস্ট্রোলজি ও চক্ষু বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদগুলো শূন্য। আবাসিক মেডিকেল অফিসার দুইজনের মধ্যে একজন; আবাসিক সার্জন তিনজনের মধ্যে দুইজন; অ্যানেসথেসিস্ট চারজনের মধ্যে দুইজন; মেডিকেল অফিসার (প্যাথলজিস্ট) দুইজনের মধ্যে একজন; ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ৩ জনের মধ্যে ২ জন ও মেডিকেল অফিসার ১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন কর্মরত আছেন। বাকি ৮টি পদে জনবল নেই। এছাড়া মেডিকেল অফিসারের (রক্ত) দুটি ও একটি রেজিস্ট্রারের পদ শূন্য রয়েছে। জেলায় ২৪ লক্ষাধিক লোকের সদর হাসপাতাল কাঠামোতে চিকিৎসক-কর্মকর্তার পদের সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে মাত্র ২২ জন্য কর্মরত থাকলেও একজন ডাক্তার দীর্ঘদিন বিদেশে আছেন; বাকি ৩৫টি চিকিৎসকের পদই শূন্য। গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৩০০ জন রোগীকে সেবা দিয়েছেন একমাত্র চিকিৎসক মাসুদ রানা। একইভাবে দু-একজন চিকিৎসক দ্বারা জরুরি বিভাগের সেবাও চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি বানিয়াচং উপজেলার জাতুকর্ণপাড়ার মৎস্যজীবী দুলাল মিয়ার দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়। কোনো রকম ভাড়ার টাকা জোগাড় করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে এসে কোনো চিকিৎসা পাননি। পরে জেলা সদরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে তাকে ঋণ করে ১৪ হাজার টাকা এনে চিকিৎসা করাতে হয়। দুলাল মিয়া মঙ্গলবার বিকালে যায়যায়দিনকে এ তথ্য জানান। এদিকে গাইনি ওয়ার্ডের সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদ শূন্য। সেখানে ডা. ফেরদৌসী ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দুটি পদ শূন্য থাকায় গাইনি ওয়ার্ডে প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী মায়েদের জটিলতা দেখা দিলে অল্পতেই সিলেটে রেফার করতে হচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোমেন উদ্দিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে জানান, 'মেডিকেল অফিসারের আটটি পদ শূন্য থাকায় বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেসব ওয়ার্ডে কনসালট্যান্ট পদ শূন্য- সে ওয়ার্ডগুলোর সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। হাসপাতালের এ সমস্যা দীর্ঘদিনের।' চিকিৎসক সংকট দূর না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'নতুন করে চিকিৎসক পদায়নের জন্য উপরে চিঠি দেওয়া আছে। অসংখ্যবার তাগিদ দেওয়ার পরও চিকিৎসক পদায়ন করা হচ্ছে না।' জনবল সংকট ও রোগী আধিক্যের পরিস্থতিতে স্বাস্থ্যের সিলেট বিভাগের সাবেক পরিচালক হবিগঞ্জের সন্তান ডা. দেবপদ রায় বলেন, 'দেশে প্রশাসন ছাড়া সরকারি বাকি সবগুলো দপ্তরেই লোকের স্বল্পতা রয়েছে। আমাদের দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তা দিয়ে সবগুলো পদ পূরণ করে সেবা দেওয়া খুব তাড়াতাড়ি সম্ভব না। একসময় হয়তো সম্ভব হবে। আমি কি সেবা দিচ্ছি? আমার সেবার মন-মানসিকতাটা কতটুকু, সেটিও দেখা উচিত। জনবল সংকট দূরীকরণে চেষ্টার পাশাপাশি আমার মানসিকতাটা এমন থাকতে হবে- যে আমি সার্ভিস দেব। সরকার আমাকে বিকালে বেসরকারি চেম্বার করার সুযোগ দিয়েছে, আমি সেটিও করব। চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দলবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে।' এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. নাজমুল হোসেনের সরকারি নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।