জলাবদ্ধতা, আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তার অভাব বোধ
যশোরে এবার ৬৫২ মন্দির-মন্ডপে পূজার প্রস্তুতি, অনিশ্চিত ৮০টি
প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
যশোরে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। প্রতীমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভাস্কর শিল্পীরা। এ বছর যশোর জেলায় ৬৫২টি মন্দির ও মন্ডপে পূজার আয়োজন চলছে। গত বছরের তুলনায় জেলায় এবার ৮০টি মন্ডপে পূজার প্রস্তুতি নেই বলে জানা গেছে। জলাবদ্ধতা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিরাপত্তার অভাব ও আর্থিক সংকটের কারণে পূজামন্ডপ কমেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোর জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ৬৫২টি মন্দির ও মন্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলছে। গত বছর জেলায় ৭৩২টি মন্ডপে পূজার আয়োজন হয়েছিল। এই হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এবার মন্ডপের সংখ্যা কমেছে ৮০টি। এর মধ্যে সদর উপজেলার ১০টি, কেশবপুর উপজেলায় ছয়টি, মণিরামপুরে ছয়টি, চৌগাছায় ১৩টি, ঝিকরগাছায় আটটি, বাঘারপাড়ায় ১৪টি, শার্শায় চারটি ও অভয়নগরে ১৯টি মন্ডপ কমেছে। ভবদহ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার প্রায় ৩৪২টি গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য এই অঞ্চলের অনেক মন্দির-মন্ডপে পূজার আয়োজন হচ্ছে না। এ ছাড়াও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর্থিকভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ জন্য পূজার আয়োজন করতে পারছেন না তারা।
চৌগাছা উপজেলার বলস্নভপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক তারক কুমার বিশ্বাস বলেন, 'আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে আমরা এবার পূজার আয়োজন করতে পারছি না। আমরা সরকারের কাছ থেকে বাওড় লিজ নিয়ে চাষ করি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বাওড়ের প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার মাছ লুট করে। এতে আমাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। নিজেদের চাঁদার টাকা ও বাওড়ের ফান্ড থেকে অনুদান নিয়ে পূজা করি। এবার চাঁদা কিংবা ফান্ডের অনুদান দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এ ছাড়াও বাওড় দখলে নিতে সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও খুব একটা সাড়া মেলেনি।'
চৌগাছার খড়িঞ্চা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ভরত কুমার বিশ্বাস বলেন, খড়িঞ্চা বাওড়টি তিন গ্রামের মৎস্যজীবীদের রুটি-রুজির প্রধান উৎস। সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে খড়িঞ্চা, জলকর মাধবপুর ও দেবালয় গ্রামের কয়েকশ' মৎস্যজীবী চাষাবাদ করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খড়িঞ্চা বাওড়ের প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। পথে বসেছেন খড়িঞ্চা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা। এ বছর আর্থিক সংকটে তিন গ্রামে পাঁচটি মন্ডপের একটিতেও এবার পূজার আয়োজন হচ্ছে না।
যশোর শহরের নীলগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শ্যামল কুমার ঘোষ বলেন, 'এ বছর দুর্গোৎসবে আনন্দের চেয়ে আতঙ্ক বেশি। চারদিকে অস্থিরতা। হিন্দুদের বাড়িঘর লুট ও মারধর করছে। ভয়ে অনেকে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে চাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুর করা হচ্ছে। উৎসবের আনন্দ শেষে কি হবে জানি না। অনিশ্চয়তায় দিন পার করছি সবাই।'
যশোর শহরের বেজপাড়া মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কারিগর জয়দেব পাল বলেন, এ বছর শহর ছাড়া গ্রামেও প্রতিমার কাজ কম হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৩৫ সেট প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি। প্রতিমা তৈরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ধরনের কাজ করা লাগে। এখনো প্রতিমার চাহিদা রয়েছে। ২০-৩৫ হাজার টাকায় এক একটি সেট প্রতিমা বিক্রি করি। এ বছর নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন অনেকে। জীবনে যা না, তাই এ বছর করতে হয়েছে। মাসিক আট হাজার টাকা বেতন দিয়ে প্রতিমা পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখতে হয়েছে।
যশোর জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি দীপংকর দাস রতন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার পূজামন্ডপ কমেছে। কেশবপুর, মণিরামপুরে জলাবদ্ধতার কারণে অনেক জায়গায় পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। দেশে বড় একটা প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে কিছুটা আতঙ্ক রয়েছে। তবে যশোরের কোথাও প্রতিমা ভাঙচুর, হুমকির কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। প্রত্যেক মন্ডপ এলাকায় হিন্দু-মুসলিম মিলে নিরাপত্তা কমিটি করা হয়েছে। সরকারিভাবে মন্দিরে পূজার জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদ্যাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।