বজ্রপাত নিরোধক প্রকল্পে কোটি টাকার ফাঁকি

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

বগুড়া প্রতিনিধি
বজ্র নিরোধক দন্ড ও বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি স্বার্থন্বেষী মহল। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাসহ আরও কয়েকটি মহল। ২০২১-২২ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় বজ্রপাত হতে প্রাণহানি রোধকল্পে 'বজ্র নিরোধক দন্ড, বজ্র নিরোধক যন্ত্র (খরমযঃহরহম অৎৎবংঃবৎ) স্থাপন খাতে বগুড়ার ১২টি উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছিল ১৮টি যন্ত্র। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। পরিকল্পনা ঠিক থাকলেও কার্যক্রম ছিল অর্থ হাতানোর। সে লক্ষ্যে যন্ত্রগুলো অর্ধেকেরও কম দামে কিনে ভাউচার দেখানো হয়েছিল দুই গুণেরও বেশি। নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থাপন করা হয়েছে এসব যন্ত্র। সবগুলো যন্ত্রের কাছাকাছি পৌঁছে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। আইকোনিক নামের একটি কোম্পানি থেকে এসব যন্ত্র ক্রয়ের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে। কোম্পানির দেওয়া তথ্যানুযায়ী প্রতিটি দন্ড বা যন্ত্র যেখানে স্থাপন করা হবে সেখান থেকে চারিদিকে ১০৫ মিটারের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা ধরে ফেলবে দন্ডটি। এছাড়া দন্ডটি যেখানে স্থাপন হবে সেই জায়গাটি ওই স্থানের মধ্যে সব থেকে উঁচু হতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মকে তোয়াক্কা করা হয়নি। কোথাও দন্ডগুলো স্থাপন করা হয়েছে ফাঁকা মাঠের মধ্যে, আবার কিছু জায়গায় হয়েছে মাটি থেকে একটি স্ট্যান্ডের ওপর। এসব স্থানে রয়েছে বড় বড় উঁচু ভবন। কয়েকটি স্থানে বজ্রপাত হয়েছে দন্ডের কাছেই। পুড়ে গেছে আবাদী ফসল। অর্থাৎ যায়যায়দিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বজ্রপাত ধরার নামে দন্ড বা যন্ত্রগুলোর সবকটিই অকেজো। সোনাতলা উপজেলায় ৪টি যন্ত্রের প্রত্যেকটির মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টাকা। এই যন্ত্রগুলো নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু সাবেক সাংসদ সাহাদারা মান্নান শিল্পী বালুয়াহাট বাজারের যন্ত্রটি তার নিজের বাড়ির কাছে স্থাপন করেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ এলাকায় একটি, হরিখালি বাজারে একটি ও চরপাড়া বাজারে একটি স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো কোনোটিই নিয়মানুসারে স্থাপন হয়নি। জানা গেছে, পরের অন্য একটি প্রকল্প দেখিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে একটি ও বালুয়াহাট বাজারে একটি স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে বালুয়াহাট বাজারেরটি স্থাপনের পরের দিনেই অলৌকিকভাবে গায়েব হয়ে গেছে। আর দলীয় কার্যালয়েরটির আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। এই দুটি প্রকল্পের কোনো কাগজপত্রেরও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বগুড়া সদরে স্থাপন করা হয়েছে ৪টি। প্রত্যেকটির মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি, উপজেলা পরিষদ ভবনে একটি, নুনগোলা হাট আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ও রহমতবালা আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি। সারিয়াকান্দিতে ৪টি। ফুলবাড়ী ইউনিয়নের চরডোমকান্দি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ প্রকল্পে একটি। হাটশেরপুর দুর্যোগসহনীয় বাসগৃহ প্রকল্পে একটি। কাজলা ইউনিয়নের মনোয়ারা-রকিব দাখিল মাদ্রাসার মাঠে একটি ও ফুলবাড়ী ডিজিটাল সেন্টারের মাঠে একটি। সবকটিই স্থাপন করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। হাটশেরপুর ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মাদ মেহেদী হাসান আলো যায়যায়দিনকে বলেন, 'দন্ডগুলো স্থাপনের সময় আমরা জনবসতি এলাকায় স্থাপন করার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা ওই সময় বলেছিলেন এটি উপরের নির্দেশ, আপনাদের নির্দেশে কোনোকিছুই হবে না। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনের কারণে এগুলো কাজেই আসছে না।' শিবগঞ্জ উপজেলার গোকর্ণ আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি। নন্দীগ্রাম উপজেলার মথুরাপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের যন্ত্রটি স্থাপন হয়েছে ফাঁকা মাঠের ১০৫ মিটারের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি নেই। এই আশ্রয়ণের বাসিন্দা বাবলু বলেন, এটি একটি ভুয়া দন্ড, এর পাশেই বজ্রপাত হয়ে ১০ কাঠা জমির ধান সব পুরে গেছে। একই কথা বলেন আশ্রয়ণের জাহিদুল ইসলাম, সজি খাতুন, রেখা বেগমসহ অনেকেই। ধুনট উপজেলায় ৩টি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে- এর মধ্যে উপজেলা পরিষদ ভবনে একটি, মথুরাপুর জি.এম.সি ডিগ্রি কলেজে একটি ও খাটিয়ামারি উচ্চবিদ্যালয়ের অদূরে মাঠের মধ্যে একটি। খাটিয়ামারি বাজারের ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, এটা কেমন বজ্র ধরার যন্ত্র। কয়েকদিন আগে এর পাশেই বজ্রপাত হলো। এগুলো সাধারণ মানুষের মনে বুঝ দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। শুধু বগুড়াতেই নয়, এই মহাপ্রকল্পে সারাদেশে ৩৩৫টি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। যার প্রাক্কলিত ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। যন্ত্রগুলো আইকোনিক নামের যে কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে তার সেলস ম্যানেজার মো. লিমন নামের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, 'আমাদের এসব দন্ড ও যন্ত্র মানভেদে দুই লাখ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের রয়েছে। তবে টিআর প্রকল্প থেকে যেসব যন্ত্র নিয়েছে ওগুলোর রেঞ্জ ১০৫ মিটার। এসব যন্ত্র স্থাপনের বেশকিছু নিয়ম আছে। যেমন- যেখানে স্থাপন করা হবে ওই স্থানটি হতে হবে সবথেকে উঁচু। নিচু স্থানে স্থাপন করা হলে তার কোনো কার্যক্ষমতা থাকবে না। এই যন্ত্রগুলো দুই ধরনের। এক ধরনের হলো- মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে দেখা ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এক ধরনের বিষয়গুলো দেখা না গেলেও কতগুলো বজ্রপাত ধরেছে তা কাউন্ট করা যায়।' তার কাছে যন্ত্রের কার্যকারিতা জানতে চাইলে তিনি শতভাগ নিশ্চয়তা দেন। কিন্তু সরেজমিনর তথ্যানুসারে এই যন্ত্র দিয়ে কোনো কাজই হয় না। সোনাতলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, 'ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক আতিকুর রহমান যে উদ্দেশ্যে এটি স্থাপন করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত হয়নি।' বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, '২০২১-২২ অর্থ বছরে এসব দন্ড স্থাপন করা হয়েছে। তবে এসব দিয়ে কোনো কাজ হয় কি না তা আমার জানা নেই।'