'রং লাগবে নাকি গো রং, বাড়ির দেয়াল লেপার জন্য লালমাটির রং'- এমনভাবে গলা ছেড়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে মাটির রং বিক্রি করেন আমিনুল ইসলাম। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে মাটির বাড়ির প্রলেপ দেওয়ার রং বিক্রি করে বেড়ান। বয়স ৫০ হলেও যেন ক্লান্তি নেই তার। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে চলেন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। রং বিক্রি করে আবার ফিরে আসেন নাড়ির টানে গ্রামে।
এতক্ষণ বলছিলাম ফেরিওয়ালা আমিনুল ইসলামের কথা। তার বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের চান্দইল চুনিয়াপাড়া গ্রামে। ফেরি করে রং বিক্রি করলেও নিজের বাড়িতেই সেই রং করার জায়গা নেই। বাড়ির দেয়াল ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ওপরে জরাজীর্ণ টিনের ছাউনি।
জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই লালমাটির এই রং মাটির বাড়ির দেয়াল ও বারান্দায় ব্যবহার করা হয়। এই অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে গভীর গেলে লাল রঙের একধরনের কাঁকরের দেখা মেলে। স্থানীয়রা এটাকে 'আঁকির' বলে থাকেন। এই আঁকির তুলে এনে খেজুরগুড়ের পাটালির মতো করে চাকতি তৈরি করা হয় এবং রোদে শুকানো হয়। এরপর ওই চাকতিগুলো এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকায় বিক্রি করেন আমিনুল। অত্র অঞ্চলে আমিনুলকে ছাড়া এ পেশায় আর কাউকে দেখা যায় না। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আমিনুল ইসলাম তার বাড়ির উঠানের পাশে চাকতিগুলো শুকাচ্ছিলেন। উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে রোদে শুকানোর পরই এগুলো বিক্রির উপযোগী হবে। কাজের ফাঁকেই কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, পড়াশোনা দ্বিতীয় শ্রেণির বেশি হয়নি তার। দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তার। বড় ছেলে বিয়ে করে বিভিন্ন কাজে জড়িত, ছোট ছেলে বিএসসি শেষে ঢাকায় একটি কারখানায় চাকরি করে। মেয়ের সংসার ভেঙে যাওয়ায় আমিনুলের সঙ্গেই থাকেন।
তিনি বলেন, বাড়ি-ভিটা ছাড়া অন্য জায়গা না থাকায় ২৫ বছর ধরে এ ব্যবসা করে চলেছেন। সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। নিজেই মাটি খুঁড়ে 'কাঁকর' তুলে সেগুলো চাকতি করে শুকিয়ে বিক্রি করতে হয়। এগুলো ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এক, দুই ও পাঁচ টাকায় বিক্রি করতে হয়। চাকতিগুলো পানিতে ভেজালে গাঢ় লাল বর্ণের রং হয়। সাধারণত ধুলো-ময়লা এড়াতেই এই লাল রং ব্যবহার করা হয়। এই প্রচলনটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ কারণে বেচা-বিক্রিও কম। তাছাড়া বয়সের ভারে অন্য কোনো কাজও করতে পারি না এখন।
তিনি আরও বলেন, এই পেশায় জড়িয়ে পড়ায় অন্য কোনো কাজ করা হয়ে উঠে না। বর্ষা মৌসুমে রং বিক্রি কমে হয়। এই সময়টায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ঘোড়া পুষতেও তো খরচ করতে হয়।
শংকর দাস নামের এক ব্যক্তি বলেন, 'আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই আঁকিরের ব্যবহার দেখে আসছি। মাটির বাড়িতে এই রং ব্যবহার করলে ধুলো-বালি কম হয়। তাছাড়া আলপনা হিসেবে ব্যবহার হয়।'
সবুজ সরকার নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, তার মা বরাবরই বাড়ির ভেতর ও বাইরে লাল মাটির রং দিয়ে লেপে দেন। বয়সের ভারে মা আগের মতো লেপতে না পারলেও লোক লাগিয়ে এখন রং করে নেওয়া হয়।
বর্তমানে ইট-পাথরের বিশ্বে কোনো একসময় হারিয়ে যাবে মাটির বাড়িগুলো, হারিয়ে যাবে আমিনুলের মতো ফেরিওয়ালা। তখন স্মৃতির পাতায় উঠে আসবে তাদের নাম।