মধুপুরের সুস্বাদু আনারস ৮২ বছর পর জিআই স্বীকৃতি পেয়ে খুশি জেলাবাসী

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
'উত্তর থিকা আইল ফল, রসে টস্‌ টস্‌ আনা আনা বিকোয়, নাম আনারস' মধুপুর গড়ের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছড়া পঙ্‌তিটির মতো করেই টাঙ্গাইলের মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী আনারসের জন্ম-বিকাশ ও বিস্তার। জেলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু রসালো আনারস চাষের ৮২ বছর পর জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দিত জেলাবাসী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মধুপুর গড়াঞ্চল রসে টস্‌ টস্‌ আনারসের রাজধানী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে অনেক আগেই। এতদাঞ্চলে সর্বপ্রথম ১৯৪২ সালে আনারস চাষের গোড়া পত্তন হয়। মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের 'মিজু বুড়ি' নামে এক বৃদ্ধ নারী উত্তরের মেঘালয় থেকে ৪০টি চারা এনে সর্বপ্রথম আনারস চাষ করেন। ভালো ফলন ও সুস্বাদু হওয়ায় পরের বছর ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের বেশকিছু লোকজন মেঘালয় থেকে ৭৫০টি চারা এনে বৃহদাকারে আনারস চাষ শুরু করেন। ওই চাষকে সমৃদ্ধ করে বতর্মানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস চাষ হয়। ৮২ বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে মধুপুর গড়াঞ্চলের সুস্বাদু এ আনারস। সম্প্রতি এমডি-২ নামে থাইল্যান্ডের একটি আনারসের জাত এনে মধুপুরে চাষ করা হচ্ছে। মধুপুরের জলছত্র বাজার আনারসের একটি বিখ্যাত হাট। প্রতিদিন সেখানে কোটি টাকার আনারস বেচাকেনা হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে ট্রাকে ভরে নিয়ে যান। আকারভেদে ২০ থেকে ৬০ টাকা ধরে প্রতিটি আনারস বিক্রি হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে আনারস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আনারস চাষিরা কেউ ভ্যানে, কেউ সাইকেল আবার কেউ ট্রাক-পিকআপ ভর্তি আনারস নিয়ে জলচ্ছত্র আনারসের হাটে বসে আছেন। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে আনারস ক্রয় করে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করছেন। পরে তা ট্রাকভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। কেরানীগঞ্জ থেকে আনারস কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী তালেব মিয়া বলেন, 'এখানকার আনারস সারাদেশেই পরিচিত খেতেও সুস্বাদু। এখান থেকে ৬০০ পিস আনারস নিয়েছি ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করি, ভালো দামে বিক্রি করতে পারব।' মধুপুরের আনারস চাষি রাসেল মিয়া বলেন, 'আমি ৬ বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেছি। এতে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বর্তমান যে বাজার দর আছে এ রকম থাকলে খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ থাকবে। আমাদের মধুপুরের আনারস জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে জেনে আমরা অনেক খুশি।' জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুপুরের কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, মধুপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের আনারস। জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা গর্বিত, আনন্দিত ও উদ্বেলিত। বিশ্বমানচিত্রে এই আনারসের কল্যাণে মধুপুর উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে টিকে থাকবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নী বলেন, চলতি বছর জেলায় ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। বাকিগুলো ঘাটাইলসহ অন্য উপজেলায়। গত বছর জেলায় ৭ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়। দুই লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা টাঙ্গাইল। জেলাটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ও চমচমের পর এবার মধুপুরের আনারস জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল। এতে আমরা আনন্দিত, সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় এর বিশ্বব্যাপী ব্রান্ডিং এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ আরও বিস্তৃত হবে।' জিআই-এর সুফল পেতে তিনি ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। টাঙ্গাইলের আরও কয়েকটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।