বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১

ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধ শতাধিক গ্রামে দুর্দশার অন্ত নেই

দু'সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি নাজুক মানবেতর জীবন যাপন
মিলন রহমান, যশোর
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধ শতাধিক গ্রামে দুর্দশার অন্ত নেই

ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধ শতাধিক গ্রামে দুর্দশার অন্ত নেই। টানা বর্ষণে ২৭ বিলের পানিতে গোটা এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নিষ্কাশনের গতি অত্যন্ত ধীর হওয়ায় কমার পরিবর্তে বরং পানির চাপ বাড়ছে। বিল ছাপিয়ে পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু পরিবার স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রেও ঠাঁই নিয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এই নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা বলছেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে অবিরাম বৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভবদহ এলাকার কেশবপুর, মণিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার জলাবদ্ধ ইউনিয়নগুলো হচ্ছে মঙ্গলকোট, বিদ্যানন্দকাটি, কেশবপুর, পাজিয়া, সুফলাকাটি, গৌরিঘোনা, হরিদাসকাটি, সুন্দলী, চলশিয়া, পায়রা, কুলটিয়া, মনোহরপুর, দুর্বাডাঙ্গা ও শ্যামকুড়।

যশোরের মণিরামপুরের কুলটিয়া, নেহালপুর এবং অভয়নগরের পায়রা, প্রেমবাগ, চলিশিয়া, সুন্দলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশংকায় এখন দিন কাটছে তাদের। গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের তিন-চার দিনের টানা বৃষ্টির পানিতে তলিয়েছে এ অঞ্চলের অন্তত ৫০টি গ্রাম। এরপর সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিতে এই গ্রামের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। এসব গ্রামে পানি ঢুকে পস্নাবিত হয়েছে বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয়। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের। এখনো বিলগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে পানি। আর এতে আরও কয়েকমাস জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা। নিরাপদ চলাফেরার পাশাপাশি গোখাদ্য, সুপেয় পানির অভাব আর নাজুক স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।

মণিরামপুরের বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ বলেন, তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্স্নুইস গেট দিয়ে হরি নদীতে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পলিতে স্স্নুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি যাচ্ছে না। বর্তমানে আবার স্স্নুইস গেটগুলো বন্ধ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ পাম্প বসিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ পানি নিষ্কাশনের খাল থেকে নদী উঁচু। সে কারণে জলাবদ্ধতার মাত্রা বাড়ছে।

একই বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষক আব্দুস সবুর বলেন, নদী খনন না করলে এ পানি কমবে না। টিআরএম প্রকল্প ছিল একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। কিন্তু পলি জমে এখন যে অবস্থা তাতে নদী খনন ছাড়া উপায় নেই।

কপালিয়ায় তিন ভেন্ট এলাকায় রাম প্রসাদ সরকার বলেন, পানির চাপে সেচ কোনো কাজে দিচ্ছে না। নদীর তলা উঁচু থাকায় পানি উপচে বাড়িতে ঢুকছে।

পানি বাড়তে থাকায় স্থানীয়রা রাস্তার ওপর ঘর বেধে গবাদি পশু নিয়ে রাখছেন। কপালিয়া থেকে মশিহাটী পর্যন্ত যেতে এ অবস্থা দেখা যায়। রাস্তার ওপর তৈরি গোয়াল ঘরে গরুকে খাবার দিচ্ছিলেন সুষমা লস্কর। বললেন, এত কষ্টে বেঁচে থাকা দায়!

কুলটিয়া গ্রামের স্বপ্না শিকদার বললেন, 'আমাদের দুরবস্থা চলছে। চারদিকে জল। কাজ করার উপায় নেই। একবেলা খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।'

পানিয়াল গ্রামের রাজু আহমেদ জানালেন, 'প্রায় এক মাস জলাবদ্ধতা আমাদের অঞ্চলে। এরপর চার দিন যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জলাবদ্ধতা আরও বেড়েছে।'

পাঁচাকড়ি গ্রামের নবীজান বেগম বাড়িঘর ফেলে ঠাঁই নিয়েছেন মণিরামপুরের নেহালপুর ইউনিয়নের বলিদাহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনে। নবীজান বেগম জানালেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে বাড়িঘরে পানি উঠছে। উঠোনে এখন বুক সমান পানি। ঘরের পানি কোমর ছুঁই ছুঁই। তাই নিরূপায় হয়ে সপ্তাহখানেক আগে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে। গরু রেখে এসেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে।

শুধু নবিজানের পরিবার নয়, বিদ্যালয় ভবনটির দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে আরও ছয়টি পরিবার। চোখে মুখে তাদের হতাশার ছাপ। কবে নিজের ভিটে মাটিতে ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতা গাজী আব্দুল হামিদ বলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তা-ই এখন ভোগান্তির কারণ। অথচ ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি ও ১৫ নভেম্বর ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার 'ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ' প্রকল্প বাতিলের দাবিতে যশোরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানালেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম প্রকল্প গণআন্দোলনে গৃহীত হলেও বিগত সরকার ২০১২ সালে 'সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার' অজুহাতে বাতিল করে দেয়। এখন এই জনপদের মণিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগর শুধু নয়, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হয়েছে খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর শহর পর্যন্ত।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জি জানিয়েছেন, হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পুনর্খনন কাজ চলমান। জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদু্যতিক সেচযন্ত্র দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরানোর কাজ চলছে। দ্রম্নত সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এদিকে, যশোরের নাবগত জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম ইতোমধ্যে ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দাবি ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করছে। জলাবদ্ধ এলাকার পানি নিষ্কাশনে দ্রম্নত পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে