শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন দুর্বৃত্তদের হামলায় লন্ডভন্ড হয়ে পড়া শেরপুর জেলা কারাগারটি এক মাস ১৬ দিনের সচল করা হয়নি। কর্তৃপক্ষের দায়সারা ভূমিকার কারণেই এখনো তা সচল করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। অন্যদিকে হামলার দিন পালিয়ে যাওয়া ৫ শতাধিক হাজতি ও কয়েদি আসামির মধ্যে এখনো দুই-তৃতীয়াংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে জেলায় বাড়ছে যেমন নানা অপরাধ, তেমনি কারাগার সচল না থাকায় পুলিশি কার্যক্রমও সীমিত। পাশাপাশি ভিন্ন জেলার কারাগারে যাওয়ার আশঙ্কায় আদালতেও বিভিন্ন মামলায় অনেক আসামি হাজির হচ্ছেন না।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের পরপরই ৫ আগস্ট বিকালে হাজারও দুর্বৃত্ত জেলা কারাগারে হামলা চালায়। অবস্থা বেগতিক দেখে কারাগার ত্যাগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব কারারক্ষী।
ওই অবস্থায় প্রায় ৮-১০ হাজার দুর্বৃত্ত লাঠিসোঁটা, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তারা ৫১৮ জন বন্দিকে বের করে আনে। পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দিদের মধ্যে ১০ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং ৭০-৮০ জন বিভিন্ন মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। আর অন্যরা বিচারাধীন ও তদন্তাধীন বিভিন্ন মামলার আসামি। হামলাকারীরা কারাগারের ৬১টি অস্ত্রের মধ্যে ৯টি অস্ত্র, চায়নিজ রাইফেলের ৮৬৪টি গুলি, শটগানের ৩৩৬টি গুলি ও কারাবন্দিদের মজুত করা খাদ্যসামগ্রী, কারাগারের বিভিন্ন মালামালসহ টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে কারাগারের মূল্যবান রেকর্ডপত্র, গাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে কয়েকটি অস্ত্র রক্ষা করে।
এ ছাড়াও দুর্বৃত্তরা কারাগারের প্রধান ফটক, কারারক্ষীদের ব্যারাক, কারাগারের সুপার ও জেলারের অফিসকক্ষ ও বাসভবনের সব আসবাবপত্র, রান্নাঘর, ক্যান্টিন পুড়িয়ে দেয়। ভাঙচুর করে আসামিদের ওয়ার্ড, কনডেমসেল ও কারা হাসপাতালে। ফলে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় জেলা কারাগার।
এদিকে ঘটনার কয়েকদিন পর কারাগারের জেলার বাদী হয়ে ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে শেরপুর সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করলে তা নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু হয়। কিন্তু সেই ঘটনার ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও ওই মামলার বিষয়ে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে জেলা কারাগারের লুণ্ঠিত অস্ত্রসহ মালামাল ফেরত বা অবস্থান জানানোর জন্য স্থানীয় ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর তরফ থেকে মাইকিং করা হয়। লুণ্ঠিত ৯টি অস্ত্রসহ বেশকিছু মালামাল ফেরত পাওয়া গেলেও রহস্যজনক কারণে কর্তৃপক্ষের কার্যকর তৎপরতার অভাবে কারাগার সচলকরণে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। জেলা কারাগারের সুপার হুমায়ুন কবীর খান বলেন, ঘটনার পরপরই কারা অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কারাগার দ্রম্নত সচলকরণে স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে লুট হওয়া কিছু গুলি পাওয়া না গেলেও ৯টি অস্ত্রই উদ্ধার হয়েছে। পলাতক হাজতি-কয়েদিদের মধ্যে ইতোমধ্যে আটকসহ ১২৫ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৯৯ জন জামিন পেলেও ২৬ জনকে পার্শ্ববর্তী জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার মাহবুবুর রহমান জানান, কারাগারের মেরামত ও সংস্কার কাজের টেন্ডার আহ্বান করতেই নানা প্রক্রিয়ার কারণে সময় নিতে হয়েছে। এখন প্রক্রিয়াগুলো প্রায় সম্পন্ন হলেও আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না।
শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, ধ্বংসমস্তূপ থেকে কারাগারকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে সংস্কার কাজ শেষ করে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময় জেলা কারাগার সচল করা সম্ভব হবে।