চিনিগুঁড়া আতপে অধিক লাভের স্বপ্ন

নওগাঁয় ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকার আমন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ইউসুফ আলী সুমন, বরেন্দ্র অঞ্চল (নওগাঁ)
নওগাঁয় বৃষ্টির পানিতে চিনিগুঁড়া আতপ ধান রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক -যাযাদি
কেউ ধান ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন। কেউ করছেন সার-কীটনাশক প্রয়োগ। আবার কেউ কেউ আউশ কাটা-মাড়াই শেষে চিনিগুঁড়া আতব (সুগন্ধি) ধান চাষের জন্য জমি তৈরি, বীজতলা থেকে চারা তোলা ও রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন তারা। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী উত্তরের জেলা নওগাঁর চাষিদের। আষাঢ়েও দেখা মিলেনি বৃষ্টির। শ্রাবণের আকাশে ঘটে মেঘের ঘনঘটা। বইতে শুরু করে শ্রাবণের ধারা। চাষিদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। অনাবৃষ্টিতে আমন চাষাবাদ কিছুটা বিলম্ব হলেও শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের বৃষ্টিতে খুশি তারা। এতে কমেছে সেচ খরচ। ধান চাষিরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিসহ সার সংকট ও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে অধিকমূল্যে রাসায়নিক সার বিক্রি হওয়ায় উৎপাদনে বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন তারা। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে গিয়ে মিলছে না ন্যায্য দাম। বাজার সিন্ডিকেটের দখলে। কৃষকের মুনাফা ফড়িয়া, আড়তদার, চালকল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ চাষিদের। সার ও ধান-চালের বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। তবে চাষিদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ব্যবসায়ী। আর কর্তৃপক্ষ বলছে, সার ঘাটতির আশঙ্কা নেই। সিন্ডিকেট করে অধিক দরে সার বিক্রি করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা কোনো বিপর্যয় না ঘটলে কৃষকের বাড়ির আঙিনা ভরে উঠবে সোনালি ধানে। নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলায় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে উচ্চমূল্যের সুগন্ধি (আতব) জাতের ৩৫ হাজার ৯১০ হেক্টর। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ১২৫ হেক্টর। এসব জমি থেকে ৯ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। ১২শ' টাকা মণ হিসাবে যার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। জেলার ১৮ হাজার ৮০০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক উন্নত জাতের ৫ কেজি ধান বীজ, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার প্রণোদনা পেয়েছেন বিনামূল্যে। গত বছর মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭২৬ মিলিমিটার। এ বছর ফেব্রম্নয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত জেলায় ৩৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আমন চাষাবাদ বৃষ্টিনির্ভর হলেও প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় দুই হাজার টাকার পানি সেচ লাগে। বৃষ্টির পানিতে চাষাবাদ করায় চলতি মৌসুমে কৃষকদের বিঘাপ্রতি অন্তত ১ হাজার টাকা সেচ খরচ কমেছে। সেই হিসেবে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে এ বছর ১৪৭ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেঁচে যাবেন ধান চাষিরা। এদিকে, আমন মৌসুমে জেলায় রেকর্ড পরিমাণ চিনিগুঁড়া আতব ধান উৎপাদন হয়। আন্তর্জাতিক বাজারেও এই চালের বেশ খ্যাতি রয়েছে। এ চালের পোলাও, বিরিয়ানি, পায়েস ইত্যাদি খাবার আদিকাল থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়। বিয়ে জন্মদিনসহ সব সামাজিক উৎসবে চিনি আতব চালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জেলার শতাধিক চালকলে উৎপাদিত সুগন্ধি চাল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। উপজেলাপর্যায়ে দেশের সর্বাধিক সুগন্ধি ধান উৎপাদনকারী জেলার মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ খরিপ-২ মৌসুমে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আতব ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গোল্ডেন (আতব) ৩৫০ ও স্থানীয় জাতের ১০ হাজার ৬০০ হেক্টর। হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভরা বর্ষায়ও বরেন্দ্র জনপদ নওগাঁয় কাঠফাটা তপ্ত রোদ। বৃষ্টির দেখা মেলেনি। বোরো ধান কাটার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে জমিতে রোপণ করতে হয় বৃষ্টিনির্ভর আমনের চারা। আষাঢ়েও বৃষ্টি না হওয়ায় এবার রোপণে কিছুটা দেরি হয়েছে। শ্রাবণের শেষ সময়ে ও ভাদ্র মাসে ঘনকালো মেঘের দেখা মেলে আকাশে। ঘন ঘন বৃষ্টি যেন কৃষকের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। মাঠে মাঠে ধান চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। আমন ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা। নওগাঁ সদর উপজেলার চক-জাফরাবাদ গ্রামের কৃষক সেকেন্দার আলী বলেন, অনাবৃষ্টিতে দুই বিঘা জমিতে চারা রোপণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। বৃষ্টির অপেক্ষায় জমি ফেলে রেখেছিলেন। পানির অভাবে জমি প্রস্তুতে অন্তত ১৫ দিন দেরি হয়েছে। অবশেষে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। অপেক্ষার প্রহর শেষে গেল কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমেছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে জমিতে হাল দিয়ে প্রস্তুত করে চারা রোপণ করেছেন। এক মৌসুমে যেখানে বিঘাপ্রতি পানি সেচ অন্তত ২ হাজার ৫০০ টাকা লাগত। সেখানে শুধু জমি প্রস্তুতে তার বিঘাতে ১ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। ২ বিঘায় তার ২ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানান এই কৃষক। বাচারি গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, আমন আবাদে রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে উঠানো পর্যন্ত ৭-৮ হাজার টাকা খরচ পড়ে। যেখানে ফলন হয় প্রায় ১৮-২০ মণ। যদি মৌসুমের শুরু থেকে ভালো দাম পাওয়া যায় তাদের জন্য সুবিধা হয়। আর বৃষ্টিতে সারের উপকারের পাশাপাশি পোকার উপদ্রব কম হয়। বৃষ্টি হওয়ায় সেচ খরচ কিছুটা কমেছে। মহাদেবপুর উপজেলার তাতারপুর গ্রামের আলতাব আলী, আরিফুল ইসলাম ও ফারুকসহ ১০-১২ জন চাষি বলেন, এবার রেকর্ড পরিমাণ জমিতে গোল্ডেন ও স্থানীয় জাতের চিনি আতব ধান চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে সার-কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। বাম্পার ফলনের আশা তাদের। মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, উপজেলাপর্যায়ে দেশের সর্বাধিক সুগন্ধি ধান উৎপাদনকারী মহাদেবপুরে এবার ৩৮ হাজার ৩২৫ মেট্রিক টন চিনি আতব ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। মৌসুমের শুরু থেকে চাষিদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন তারা। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন তিনি। নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি থাকলেও পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ায় বাম্পার ফলনের লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা। জেলায় সারের মজুত সন্তোষজনক। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ অধিক দামে সার বিক্রি করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।