দাগনভূঞায় বন্যায় ক্ষতি প্রায় ২৩৭ কোটি টাকা
অনিশ্চয়তায় দিনপার করছেন বন্যার্তরা
প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় রক্ষা পায়নি কোনো কিছু। একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়, ফেনীর মানুষের কাছে এবারের বন্যা ছিল এমনই।
জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা শুরুতে বন্যাকবলিত হলেও পরে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে ফেনীর মানুষের জীবনে। টেলিযোগাযোগসহ সব ধরনের যোগাযোগ থমকে যায়। এই জেলার অনেক প্রবীণ বাসিন্দার স্মৃতিতে এমন বন্যার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই আকস্মিক বন্যায় পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও পাননি বেশিরভাগ মানুষ। স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় সম্পদহানির পাশাপাশি ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানিও। এতে দাগনভূঞা উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৭৬ হাজার ১৩০ টাকা।
উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে মোট আয়তন ১৬৫.৮৪ বর্গকিলোমিটাররের মধ্যে ১৪২.৫ বর্গকিলোমিটার বন্যায় ক্ষতি হয়। এতে পাকা সড়ক সম্পূর্ণ ৮২ কিলোমিটার, আংশিক ১৫০, ইট/খোয়া দ্বারা নির্মিত সড়ক সম্পূর্ণ ৯.৫ ও আংশিক ২১.৮, কাঁচা সড়ক সম্পূর্ণ ৩০ ও আংশিক ৮০ কিলোমিটারসহ মোট ক্ষতিগ্রস্ত সড়কপথ সম্পূর্ণ ১২১.৫ ও আংশিক ২৫১.৮ কিলোমিটার। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৪৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে বন্যাঞ্চল, বনায়ন, নার্সারি এলাকায় সম্পূর্ণ ২৩ হেক্টর ও আংশিক ২৭ হেক্টর ক্ষতি হয়। এতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৮ লাখ ৯৬ হাজার ৩০ টাকা। উপজেলায় মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০২টির ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি দুই লাখ টাকা, উচ্চ বিদ্যালয় ২৮টির ক্ষতির পরিমাণ ২৮ লাখ টাকা, কলেজ ৪টি ক্ষতির পরিমাণ ৪ লাখ ৮০ হাজার, মাদ্রাসা ২৩টি ক্ষতি ২৩ লাখ টাকা ও অন্যান্য কমিউনিটি স্কুল একটির ক্ষতি ৪০ হাজার টাকা। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভীর-অগভীর নলকূপের সম্পূর্ণ ক্ষতি ১০ কোটি ৮ লাখ টাকা ও আংশিক ক্ষতি ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সম্পূর্ণ ক্ষতি ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও আংশিক ক্ষতি ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, পুকুর-জলাশয়সহ মোট ক্ষতির পরিমাণ ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা ও পুকুরের আংশিক-সম্পূর্ণ ক্ষতি ১৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বন্যার পানিতে ভেড়া ও ছাগল (গরু মহিষ) সহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বিভিন্ন খামার, প্রান্তিক কৃষকদের লালন-পালনকৃত মৃত ও ভেসে যাওয়া হাঁস, মুরগির ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কৃষিখাতে এ বছর উপজেলায় আমনের ৪৭৫ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৫ হাজার টাকা, ২০৪ হেক্টর জমিতে রোপণকৃত আমনের জমি বন্যার পানিতে ডুবে ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৫ হাজার আটশ টাকা। এ নিয়ে আমনে ক্ষতির পরিমাণ ৬ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৮০ হেক্টর জমিতে কৃষকের রোপণকৃত শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে পাঁচ কোটি ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আট হেক্টর জমির ফসল ও অন্যান্য ফলফলাদির বাগানের ক্ষতি হয়েছে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া উপজেলার ০.৫০ হেক্টর জমিতে আবাদকৃত আদার ক্ষতি হয়েছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। উপজেলার ১৬৭ হেক্টর জমিতে আবাদকৃত আউশের জমি ডুবে দুই কোটি ৯৬ লাখ ছয় হাজার ৮৫০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে এ উপজেলায় কৃষি সেক্টরে ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি ৪৪ লাখ ৯ হাজার ৮৫০ টাকা। অন্যান্য খামার (হ্যাচারি, মৎস্য চিংড়ি ইত্যাদি) মোট ১৪৭৫ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ ৫৭ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
উপজেলার কোরোনিয়া বাসিন্দার সাহিদা আক্তার খানম জানান, 'হঠাৎ বন্যার পানি বৃদ্ধি হওয়ায় আমার কাঁচা ঘরসহ সব আসবাবপত্র বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গায়ের কাপড় ছাড়া কিছুই নিতে পারিনি। এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠব জানি না।'
উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের সংবাদকর্মী নাজমুল হাসান শুভ জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার পর থেকে বন্যার পানি বাড়তে থাকায় পরিবার নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। পানি নেমে যাওয়ার পর ঘরে গিয়ে দেখি কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব নষ্ট হয়ে গেছে।
ইউএনও নিবেদিতা চাকমা জানান, দাগনভূঞা উপজেলায় ভয়াবহ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মোট দুইশ' চৌত্রিশ কোটি আশি লাখ ছিয়াত্তর হাজার একশ' তিরিশ টাকা। বন্যার্ত মানুষের সাহায্যার্থে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানানো হয়েছে।