বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ভারী বর্ষণে ফের বন্যার শঙ্কা আতঙ্কে পানিবন্দি মানুষ!

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা প্রবল বর্ষণে মাতামুহুরি নদীর পানির স্রোতে ভেঙে যাওয়া বসতবাড়ি -যাযাদি

টানা ৩ দিনের ভারী বর্ষণে দেশে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পানিবন্দি কয়েক হাজার মানুষ। এদিকে, দেশজুড়ে ভারী ও টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। তিন দিনের বৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-রাস্তা ও ঘের-পুকুর তলিয়ে গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, পরপর দুইবারের বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ভারী বর্ষণে আবারও তৃতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলা। গত দুই দিনের বৃষ্টিতে বাড়তে শুরু করেছে বন্যার পানি। একইসঙ্গে আতঙ্ক বাড়ছে পানিবন্দি ও বানভাসিদের মধ্যে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন অনেকেই।

রোববার সকালে দেখা গেছে, উপজেলার কালাপাকুজ্জ্যা ইউনিয়নের হোসেনপুর, রাজাপুর, সালামপুর, গুলশাখালী ইউনিয়নের সোনারগাঁও, বগাচতর ইউনিয়নের গাউসপুর, ফরেস্ট অফিস, ছোট লোহাকাঠ বাগান, মাইনীমুখ ইউনিয়নের এফআইডিসি টিলা, মাদ্রাসা টিলা, পূর্ব জারুল বাগান, সদর ইউনিয়নের ঝর্ণাটিলা, ভাইবোন ছড়া ও আটারকছড়া ইউনিয়নের লেমুছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চলগুলো ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পস্নাবিত হয়েছে। ডুবে আছে বসতঘর ও সড়ক।

বন্যার্ত লংগদু সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিলা গ্রামের আসমা খাতুন বলেন, 'বন্যার পানি আবার বাড়ছে। মানুষ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। গত বন্যায় আমার প্রায় এক একরের ফসলি জমি ভেসে গেছে। এ ছাড়া খামার ও সবজির ক্ষেতের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সব শেষ এখন আর কিছুই বলার নেই।'

কালাপাকুজ্জ্যা ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকার সালমান খান বলেন, 'বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বাড়িতে এসেছি মাত্র কয়েক দিন হয়। অনেক কিছু গুছিয়ে বসবাসের উপযোগী করেছি। গতকালের (শনিবার) বৃষ্টিতে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অবস্থা। আলস্নাহ সহায় নাহলে আমাদের আর কিছুই করার নেই।'

সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিক্রম চাকমা বলি জানান, 'টানা বৃষ্টিতে কাপ্তাই হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ায় ফের লংগদুতে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হচ্ছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করছি।' উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কফিল উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ফের লংগদু উপজেলা বন্যার কবলে পড়ছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ রাখছি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন। বৃষ্টি না হলে আমাদের বন্যা পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে। পাশাপাশি বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হবে।'

উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, লংগদু উপজেলার ৭ ইউনিয়নের প্রায় হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন শত শত মানুষ। এদিকে জেলা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হচ্ছে। শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বর্তমানে সমুদ্রে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত চলছে।

অন্যদিকে কর্ণফুলী পানিবিদু্যৎ কেন্দ্র সূত্র জানা যায়, হ্রদের পানি ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। বর্তমানে হ্রদে ১০৮ দশমিক ৫৩ মিন সি লেভেলে (এমএসএল) পৌঁছে গেছে। হ্রদে পানি ধারণ ক্ষমতা ১০৯ এমএসএল।

তবে লংগদুবাসীর দাবি, এখনই কাপ্তাই বাঁধের জলকপাট খুলে দিয়ে বর্তমান পানির স্তর থেকে কমপক্ষে ৮-১০ ফিট কমিয়ে দিলে লংগদুসহ বাঁধ সংলগ্ন আশপাশের নিম্নাঞ্চলের হাজারো মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। সরকার ও বাঁধ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের এখন এমনটাই দাবি বলে জানান পানিবন্দি লংগদুবাসী।

প্রসঙ্গত, হ্রদের পানি কমাতে গত ২৫ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিন বাঁধের ১৬টি গেট খোলা ছিল। পানির স্তর ১০৮ এমএসএলের নিচে চলে আসায় ৯ সেপ্টেম্বর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে গত তিন দিনের টানা প্রবল বর্ষণে মাতামুহুরি নদীর উজান থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানিতে মাতামুহুরি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে চকরিয়া পৌর এলাকা ও পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। বানের পানির স্রোতে ভেঙে গেছে ২০টির মতো বসতবাড়ি। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। শনিবার সকালেও ভারী বর্ষণ ও জড়ো হওয়া অব্যাহত রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, শুক্রবার গভীর রাতে চকরিয়া পৌরসভার কোচপাড়া, বাঁশঘাটা এলাকায় মাতামুহুরি নদীর পাশে পৌর শহর রক্ষা বাঁধের পাশে পানির স্রোতে ভেঙে গেছে ১২ পরিবারের বসতবাড়ি। আরও ৪০ পরিবারকে গভীর রাতে ইউএনও ফখরুল ইসলাম গিয়ে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন।

এদিকে, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। ভারী বৃষ্টিপাতে ও জড়ো হাওয়ায় চকরিয়া উপজেলার বমু, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, ফাঁসিয়াখালি, হারবাং, বরইতলী, বিএমচর ইউনিয়নে অনেক বসত-বাড়ি ও আমন ধানের ক্ষেতের ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে এবং কিছু গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে পেকুয়ার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। উপকূলীয় এসব ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকার লোকজন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানান, তার ইউনিয়নের মানিকপুর এলাকায় নিম্নাঞ্চলের প্রায় দুই শতাধিক বসতবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে কাজ করছেন। ইউএনও ফখরুল ইসলাম এলাকার জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেন এবং পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে শুকনো খাবার বিতরণ করেন।

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর, ফসলের ক্ষেত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও রাস্তা। ঘর থেকে বের হতে না পেরে ও কাজ করতে পারছেন না দিনমজুর, ভ্যানচালক ও শ্রমজীবী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এতে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা। ক্ষতি হয়েছে আগাম শীতকালীন সবজি চাষিদেরও।

কলারোয়া বেত্রবতী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কলারোয়া প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক রাশেদুল হাসান কামরুল জানান, তার স্কুলের আঙিনা, বারান্দা ও ক্লাসরুম পানিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমনকি পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড মির্জাপুরের বিভিন্ন এলাকা ও রাস্তাঘাট পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়ির আঙিনায় পানি উঠেছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলের পড়া-লেখা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গোটা পৌর এলাকার প্রায় একই চিত্র।

তুলশীডাঙ্গা গ্রামের ভ্যানচালক নাসির জানান, 'বাড়ি ও আশপাশের রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে ভ্যান নিয়ে বাইরে বের হয়ে ভাড়া পাওয়াও যাচ্ছে না। প্রতিদিন চাল-তরকারি কিনে সংসার চালাতে হয়। গত ৩দিন আয় না থাকায় কষ্টে আছি।' দিনমজুর আজিজ জানান, ৩দিন ধরে ঘরে বসে আছি। কাজকর্মে যেতে পারছি না। পরিবার নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।'

মাছের ঘের ব্যবসায়ী আব্দুল হক জানান, 'অনেকের মাছের ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। কেউ নেট-পাটা দিয়ে মাছ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কারো ঘের-পুকুরের আইল সমান পানি থৈ থৈ করছে।' চন্দনপুরের কৃষক মনিরুজ্জামান জানান, 'ফসলের ক্ষেতে অতিরিক্ত পানি জমে যাওয়ায় আবাদ নষ্ট হচ্ছে।'

এদিকে, পৌরসভা ও উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির আঙিনা, রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। পর্যাপ্ত ও যুগোপযোগী ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে অনেকে বলছেন।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ১৩ সেপ্টেম্বরে ভোর হতে ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুর পর্যন্ত উপজেলায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৭ মিলিমিটার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে