সুস্থ মানুষকে প্রতিবন্ধী বানানোর কারিগর সমাজসেবা অফিসার মশিউর
প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ইমরান হোসাইন লিখন, গাইবান্ধা থেকে ফিরে
টাকা আছে তো সুবিধা আছে। টাকা হাতে করে অফিসে গেলেই মেলে প্রতিবন্ধী কার্ড। ডাক্তারকে মেটানোর দায়িত্বটাও সমাজসেবা কর্মকর্তারই। রাজনৈতিক প্রভাব ও নিজের কুকৌশল কাজে লাগিয়ে অসাধ্যকে সাধন করেন মশিউর রহমান নামের এই সমাজসেবা কর্মকর্তা। সাঘাটা-ফুলছরি-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপনের একান্ত কাছের ব্যক্তি ছিলেন। এতে করে স্থানীয়রা তাকে কখনোই কিছু বলতে পারেনি।
সুস্থ-সবল মানুষদের প্রতিবন্ধী বানানো, স্বামী থাকতেই বিধবা বানানো, অল্প বয়সেই বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করাসহ নানা ধরনের অসাধ্যকে সাধন করে থাকেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান। হাজার পাঁচেক টাকা হলেই সুস্থ মানুষকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে কার্ড করে দেন। এছাড়া কার্ডধারীদের সরকার প্রদত্ত ভাতা বছরের পর বছর তুলে নেন। এ কাজে তার হয়ে কাজ করে থাকেন চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গ্রাম পর্যায়ের বেশকিছু আওয়ামী নেতা। অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রতিবন্ধীর কার্ড ইসু্যর ব্যবস্থা করেন তিনি। এমনও গ্রামে আছে, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ কার্ডধারী প্রতিবন্ধী। গোপনে-প্রকাশ্যে তারা সরকার প্রদত্ত ভাতা পান। অথচ গরিব পরিবারের প্রকৃত অনেক প্রতিবন্ধী টাকার অভাবে কার্ড করতে পারেননি।
সাঘাটা উপজেলা সমাজসেবা অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট হলেও যেন দেখার কেউ নেই। এসব ব্যাপারে উপরের কর্মকর্তার কাছে মৌখিক অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। ফলে এ উপজেলায় সমাজসেবা অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলছে।
উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছর সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক উপজেলার ১০ ইউনিয়নে অতিরিক্ত ৭৬৬৪ প্রতিবন্ধীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে পদুমশহর ইউনিয়নে ৮৪০, ভরতখালী ৫৭৯, সাঘাটা ৫১২, মুক্তিনগর ৬৬০, কচুয়া ৭০৪, ঘুড়িদহ ১৩২১ হলদিয়ায় ৬৯৫, জুমারবাড়ীতে ৮০২, কামালেরপাড়ায় ১০১৮ ও বোনারপাড়ায় ৫৩৩ জনের তালিকার জন্য বরাদ্দ হয়।
নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রতিবন্ধী ভাতাভুক্ত হতে অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে কেবল প্রতিবন্ধীদের সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্তকরণ এবং প্রতিবন্ধী পাওয়া না গেলে বরাদ্দ অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান নীতিমালার তোয়াক্কা করেননি। আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাই করতে তিনি ইউনিয়নভিত্তিক সরেজমিন যান। সে সময় প্রতি ইউনিয়নে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ প্রতিবন্ধী পান। তাদের কাছ থেকে অনলাইনের আবেদনের কপি, সুবর্ণ কার্ডের ফটোকপি জমা নিলেও নাম তালিকাভুক্ত হয়নি।
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের মথরপাড়া গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে শাহরিয়ার রহমান শান্তর (১৩) নামে ২০১৬ সালে প্রতিবন্ধী সুবর্ণ নাগরিক কার্ড ইসু্য হয়। শান্তর মা শেরেনা বেগম জানান, এত বছর ধরে ছেলের প্রতিবন্ধী ভাতা হয়নি। এবার যাচাই-বাছাইয়ের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন কপিসহ প্রয়োজনীয় কাজপত্র উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার হাতে দেন। আশায় ছিলেন অসহায় ছেলের নামে এবার প্রতিবন্ধী ভাতা হবে! কিন্তু পরে দেখেন অনেক সুস্থ-সবল ও সচ্ছল লোকজন প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা পেলেও তার ছেলের ভাতা জোটেনি। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় ভাতা হয়নি।
মথরপাড়া গ্রামের জুয়েল হকের বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে জনি আক্তার (১৮)। জনির মা হামিদা বেগম জানান, 'আমরা গরিব মানুষ, টাকা দিতে পারিনি, এ কারণে ভালো মানুষের নামে ভাতা হলেও আমার মেয়ের নাম ভাতাভুক্ত হয়নি।' উপজেলার প্রায় সব কয়টি ইউনিয়নে এ রকম প্রতিবন্ধী ভাতাবঞ্চিত অসংখ্য পরিবার।
মুক্তিনগর ইউপি চেয়ারম্যান আহসান হাবীব লায়ন জানান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান দালাল নিয়োগ করে টাকার বিনিময়ে সুস্থ ও সচ্ছলদের নামে প্রতিবন্ধী তালিকা প্রণয়ন করেন। তাই প্রকৃত প্রতিবন্ধীরা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। মাইকিং করে ডেকে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সাঘাটা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি সাড়া দেননি।