কয়েক দিন আগেও ছিল সবুজ ফসলের ক্ষেত। ভালো ফলন হবে- এমন আশায় দিন গুনছিলেন পরশুরামের কৃষকরা। কিন্তু ২০ আগস্টের বন্যার পানিতে সব ফসল নষ্ট হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। মাঠের পর মাঠ ঢেকে গেছে বালুর স্তূপে। নিচু জমি উঁচু হয়ে গেছে। বালুর স্তূপ না সরালে জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তায় পরশুরামের হাজারও কৃষকের এখন মাথায় হাত। জমি চাষযোগ্য করে তুলতে তারা এখন সরকারি সাহায্য চান।
অন্যদিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের এসব বালু ও পলি মিশ্রিত জমিতে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, তরমুজ, বাদাম, ঢেড়শ ও মিষ্টি আলু চাষাবাদের পরামর্শ দিয়েছেন। এসব বালু ও পলি মিশ্রিত জমিতে ভালো ফলন হবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
পরশুরামের দক্ষিণ কাউতলী গ্রামের কৃষক আবু তালেব মজুমদার। ৩০ শতক জমিতে তার আখক্ষেত ছিল। আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে গুড় তৈরি করে সংসার চলত। তিনি বলেন, 'পাঁচ-সাত ফুট উঁচু বালুর স্তূপ জমে গেছে জমিতে। শুধু আখের মাথাগুলা দেখা যাচ্ছে। ধারকর্জ করে ৯ কানি জমিতে রোপা আমন লাগিয়েছিলাম। সে জমিতেও বালুকাদা জমে আছে। নতুন করে আমনের চারা এনে রোপণ করতে হলে প্রতি কানিতে (২০ শতক) ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। ঘরে খাবার নেই। চাষাবাদ করতে না পারলে, খাব কী?'
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলার পরশুরামের প্রায় ২০০ হেক্টর জমি কয়েক ফুট বালুতে ঢেকে গেছে। কৃষকদের দাবি, দ্রম্নত যেন সরকারিভাবে জমি থেকে বালুর স্তূপ অপসারণ করা হয়। অথবা যাদের জমিতে বালুর স্তূপ পড়েছে, তাদের যেন বালু বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়।
উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম অলকা গ্রামের কৃষক নুর আহাম্মদ (৬৫) ও মো. আলম (৪২) বলেন, বন্যার পানির সঙ্গে আসা বালু জমে গ্রামের জমিগুলোতে তিন-চার ফুট উঁচু স্তূপ হয়ে গেছে। এগুলো অপসারণ করা না গেলে আগামী ১০-১৫ বছরেও কৃষকরা জমিতে চাষাবাদ করতে পারবেন না।
গত ২০ আগস্ট পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন নিজ কালিকাপুর গ্রাম থেকে উজানের পানি ফেনী জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। এতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর অন্তত ১৫টি স্থানে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় একের পর এক গ্রাম। বন্যায় উপজেলার ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় উপজেলা প্রশাসন। বন্যায় পরশুরামে দুইজনসহ ফেনীতে ২৯ জনের মৃতু্য হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেলেও কৃষিজমিতে বালুর স্তূপ রয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এখানকার ১১টি গ্রামের প্রায় ২০০ হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হয়ে গেছে। নিজ কালিকাপুর, পূর্ব অলকা, পশ্চিম অলকা, নোয়াপুর, ডুবলাচাঁদ, সাতকুচিয়া, দক্ষিণ কাউতলী, উত্তর কাউতলী, চম্পক নগর, কাশিনগর ও শালধর গ্রামের বাইরেও নদীর আশপাশে কিছু কিছু জমিতে বালুর স্তূপ জমাট হয়ে থাকতে দেখা গেছে।
উপজেলার সীমান্তবর্তী মির্জানগর ইউনিয়নে দেখা যায়, আবাদি জমিতে চার থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত বালুর স্তূপ। এসব জমিতে স্থানীয় কৃষকরা ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করতেন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, নিজ কালিকাপুর সীমান্তের অপর পাশে ভারতের বলস্নামুখা খালের বাঁধ কেটে দেওয়ায় মুহুরী নদীর পানি নিজ কালিকাপুর গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সিফাত হাসান জানান, উপজেলায় শুধু পশ্চিম অলকা গ্রামেই ৯০ হেক্টর ফসলি জমিতে বালু জমে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া কালিকাপুর গ্রামে ৪০ হেক্টর, পূর্ব অলকা গ্রামে ২০ হেক্টর, দক্ষিণ কাউতলী, উত্তর কাউতলী ও চম্পকনগর গ্রামের প্রতিটিতে ১০ হেক্টর করে, ডুবলার চাঁদ গ্রামে ৬ হেক্টর, নোয়াপুর ও কাশিনগর গ্রামে ৫ হেক্টর করে, সাতকুচিয়া ও শালধর গ্রামে ২ হেক্টর করে জমির ওপর বালু জমে গেছে। উপজেলায় মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পাশেই আরও কিছু গ্রামের জমিতে বালু জমে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।
নিজ কালিকাপুরের কৃষক মো. ইউসুফ জানান, বলস্নামুখা বাঁধ কেটে দেওয়ার পর প্রায় সাত-আট ফুট উচ্চতার বিশাল স্রোত তার জমির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এই বালুর স্তূপের মধ্যে ধান চাষ করা সম্ভব নয়। জমি উঁচু হয়ে যাওয়ায় শীত মৌসুমে পানিও পাওয়া যাবে না। এরই মধ্যে গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যার পানির সঙ্গে ফুলগাজী উপজেলায়ও কিছু কিছু জমিতে বালু জমেছে। পানির স্রোতের কারণে অনেক জমি গভীর হয়েছে আবার অনেক জমি বালু জমে উঁচু হয়ে গেছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, বিষয়টি তিনি জেনেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।