বন্যায় চাঁদপুরে ১৯২ গ্রামীণ সড়ক ও ১২ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি

লংগদুর কৃষিতে ক্ষতি ১৮ কোটি টাকার

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
চাঁদপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট ও পানের বরজ -যাযাদি
এবারের বন্যায় চাঁদপুরের ছয় উপজেলায় ১৯২ গ্রামীণ সড়ক ও ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে রাঙামাটির লংগদুর কৃষিতে ১৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিদিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট- চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে বন্যায় কচুয়া, শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ এবং অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় ১৯২ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪ কালভার্ট। এতে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। গত কয়েকদিন বন্যাদুর্গত শাহরাস্তি, কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ গ্রামীণ পাকা সড়কে পানি উঠেছে। এখন পানি কমলেও সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙন ভেসে উঠছে। বহু স্থানে পাকা অংশ পানিতে ভেসে গেছে। চাঁদপুর সদর, হাইমচর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যে কারণে এই তিন উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ পাকা সড়ক পানির নিচে দীর্ঘ প্রায় ১ মাস। সড়কের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ায় এবং যানবাহন চলতে গিয়ে সড়কগুলোর ক্ষতি হয়। যার ফলে সড়কের পাশের মাটি নরম হয়ে ভেঙে পড়ছে। কিছু স্থানে সড়কের পাশে থাকা বড় বড় গাছ উল্টে পড়েছে। এতে সড়কের পাশে বড় গর্ত সৃষ্ট হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় সদরে ১২টি, হাইমচরে ১০টি, হাজীগঞ্জ ৪৫টি, কচুয়ায় ২২টি, শাহরাস্তিতে ৫৩টি এবং ফরিদগঞ্জে ৫০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৬ উপজেলায় কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪টি। কচুয়া উপজেলার আশ্রাফপুর ইউনিয়নের পিপলকরা গ্রামের কৃষক শহীদ উলস্নাহ বলেন, বানের পানিতে সড়কের পাশাপাশি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। গর্ত হওয়ার কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল এখন ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শাহরাস্তি উপজেলার উনকিলা গ্রামের মনির হোসেন বলেন, তাদের এলাকায় বানের পানিতে বহু সড়ক তলিয়েছে। এসব সড়ক ভেঙে এখন বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। তবে কিছু সড়ক আগে থেকে ভাঙা ছিল। এখন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলার মানিকরাজ গ্রামের মোক্তার হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টিতে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভাঙন দেখা দিয়েছে। সড়কের পাশের অংশগুলো বেশি ভেঙেছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান কবির বলেন, 'বন্যার পানি এখনো পুরো নামেনি এবং জলাবদ্ধতাও রয়েছে। আমরা গ্রামীণ সড়ক ও কালভার্টের ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত করিনি। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছি। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও কালভার্ট মেরামতের সম্ভাব্য ব্যয় (প্রাক্কলন) তৈরি করছি।' এদিকে, কুমিলস্না, ফেনী ও নোয়াখালী জেলার বানের পানিতে তলিয়ে গেছে চাঁদপুরের কচুয়া, শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ ফসলি জমি। একই সময় টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় পান, আখ, রোপা আউশ ও আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে জেলার ৬ উপজেলায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। কৃষি বিভাগ বলছে, ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে আমনের বীজ ও সার সরবরাহ শুরু করেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় জেলায় ৪৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় ৩৩ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফসল ছিল। দন্ডায়মান ফসল আছে ৩২ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে। আক্রান্ত ফসলিজমির পরিমাণ ১২ হাজার ১৪৭ হেক্টর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ হাজার ৭৮৬ হেক্টর। বন্যাদুর্গত কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলায় বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রোপা আউশ পানির নিচে তলিয়ে আছে। কিছু মাঠে রোপা আউশ দেখা গেলেও ধানের গোড়া পচে নুইয়ে পড়েছে। জেলার সবচাইতে বেশি আখের আবাদ হয় ফরিদগঞ্জ ও সদর উপজেলায়। দুই উপজেলায় জলাবদ্ধতার কারণে ১২৮ হেক্টর জমির আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত। একই সঙ্গে জমিতে থাকা আখ নুইয়ে পড়েছে। এসব আখ বিক্রি করলেও দাম পাওয়া যাবে না। ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কলেস্নাল কিশোর সরকার বলেন, জলাবদ্ধতায় উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির রোপা আউশ, আমন, আখ, বীজতলা ও অন্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে- পানি নেমে গেলে বীনা জাতের বিআর-২২ ও ২৩ জাতের ধান আবাদ করার। কারণ খুব দ্রম্নত সময়ে এ ধানের ফলন হয়। শাহরাস্তি রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা উনকিলা গ্রামের কৃষক কেরামত আলী বলেন, তার ১ একর জমিতে আউশের আবাদ আছে। ধান কর্তনের সময় হয়েছে। কিন্তু এখন সবই শেষ। শাহরাস্তি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আয়শা আক্তার বলেন, উপজেলার বন্যাকবলিত ইউনিয়নের মাঠ জরিপে ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৪ হাজার কৃষকের তথ্য পেয়েছি। বিভিন্ন ফসলে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রাথমিক ক্ষতির আশঙ্কা করছি। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে হাইমচর উপজেলার প্রায় ১০০ হেক্টর জমির পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার উত্তর আলগী ইউনিয়নের মহজমপুর গ্রামের পানচাষি আবু তাহের জানান, তিনি এ বছর ৪০ শতাংশ জমিতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছেন। টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় দুটি পানের বরজ। বোরজের ভবিষ্যৎ কি হবে তাও বলতে পারছে না তিনি। হাইমচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকিল খন্দকার বলেন, উপজেলার ১১৯ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ আছে। অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে প্রায় ১০০ হেক্টর জমির পান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পান চাষের সঙ্গে জড়িত ১ হাজার ৭২ কৃষক। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এবং ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ ছিদ্দিকী বলেন, আমাদের মাঠ জরিপের তথ্যমতে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় প্রায় ৪৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত। ফসলের মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠে থাকা রোপা আউশ, আখ ও পান। পানিতে তলিয়ে ক্ষতি হয়েছে আমন এবং বীজতলা। ইতোমধ্যে সব উপজেলায় কৃষকদের বীজ, সার ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পার্বত্যাঞ্চলের কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়নি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলাও। এবারের দুই দফার বন্যায় ১৭ কোটি ৬১ লাখ ৮৮ হাজার ১২৫ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নিরূপণ করেছে। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এলাকার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। বন্যায় লংগদুর কৃষি অঞ্চলে ৩০৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার আটারকছড়া, লংগদু সদর, বগাচতর ও গুলশাখালী ইউনিয়নে ফসলের বেশি ক্ষতি হয়েছে। সাতটি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ৮০ হেক্টর সবজি বাগান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ও আমন খেত। যা ১০৫ হেক্টর ও ১২০ হেক্টর জমি। আমন ধানের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাঙামাটির লংগদুতে শুধু আমনের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার মতো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্ষতির যে আর্থিক মূল্য নিরূপণ করেছে প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়ে বেশিও হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে আনতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন শুরু করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে লংগদু উপজেলা পরিদর্শন করেছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তারা। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের বন্যায় লংগদুতে শুধু রোপা আমনের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ১২০ হেক্টর জমির রোপা আমন সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ৯৬০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চলতি মাসে আউশ ধান ঘরে তোলার মৌসুম। কিন্তু ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে আউশ ধানের খেত লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। লংগদুর ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আটারকছড়া ও লংগদু সদর। উপজেলায় এবার ১ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে ২৪০ হেক্টর জমির ফসল। একই সঙ্গে আউশের ২১০ হেক্টর বীজতলা। উপজেলায় ১২,৫৫ হেক্টর আউশের মধ্যে ২১০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া সবজি ১৬০ হেক্টর এবং পেঁপেসহ অন্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে চলতি বন্যায় উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে কমবেশি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো হলো- আটারকছড়া, কালাপাকুজ্জ্যা, গুলশাখালী, বগাচতর, ভাসান্যাদম, মাইনীমূখ ও লংগদু সদর। আটারকছড়ার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক অমল চাকমা বলেন, এক মাসে দুই দফায় বন্যায় ডুবেছে তার ক্ষেত। সবশেষ চারা রোপণ করার কয়েক দিন পর থেকে বন্যা শুরু হয়। এতে তার জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এখন বন্যার পানি কমলেও নতুন করে চাষ করার মতো সময় নেই। তা ছাড়া সার, বীজ এবং শ্রমিকের মজুরি বাবদ যে অর্থ প্রয়োজন সেটাও হাতে নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লংগদু অফিসের উপ সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা রতন চৌধুরী বলেন, আমরা এ পর্যন্ত লংগদুর ৭টি ইউনিয়নের আনুমানিক ১৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষি খাতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। শিগগিরই ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় করতে পারব। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, কৃষক ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে এ আশায় ক্ষতির পরিমাণ পরিমাপ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। যদি কৃষক প্রণোদনা আসে সেটি যথানিয়মে কৃষকদের বিতরণ করা হবে।