ভরা মৌসুমেও মিলছে না দেখা
জৌলুস হারাচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ!
প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আল ইমরান শোভন, চাঁদপুর
'ভরা মৌসুমেও দেখা মিলছে না ইলিশের! সরবরাহ কম থাকায় কর্মমুখর মাছঘাট দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
গত ৫-৬ বছর আগেও ইলিশ খ্যাত জেলা চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশ সরবরাহ বেশি থাকায় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের বেচাকেনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো।
কিন্তু, বর্তমান চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ইলিশ ভোজনরসিকরাও দরদাম নিয়ে অনেকটা বিরক্ত।
অবশ্য, মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবতায় দরদামে তার কোনো ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা সাধারণও ইলিশের দরদামের হিসাব মিলাতে পারছেন না।
নুর মোহাম্মদ নামের পঞ্চাশোর্ধ শ্রমিকের জেলার বৃহৎ চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন। ট্রলার থেকে মাছ নামানো এবং তা বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য ককসিটে প্যাকেটজাত করা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো। কিন্তু আগের সেই ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন নুর মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, আগে ঘাটে প্রচুর ট্রলারে করে ইলিশ আসতো। এখন আর সেই ইলিশের দেখা মিলছে না।
নুর মোহাম্মদ বলেন, 'আগে ঘাটে প্রতিদিন একজন শ্রমিক ৫-৬শ' টাকা আয়ের পাশাপাশি ২-৩টি করে ইলিশ পেত। কিন্তু ইলিশ সরবরাহ কম থাকায় শ্রমিকের জন্য বরাদ্দকৃত ইলিশের আর দেখা মিলছে না। যেই মজুরি পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে পরিবার-পরিজন চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নুর ইসলাম বকাউল নামের অপর শ্রমিক বলেন, 'ঘাটে শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। ১০-১২ বছর আগে জেলার এই বৃহৎ মৎস্য আড়তে প্রায় তিনশর মতো শ্রমিক কর্মরত ছিল। বর্তমানে তা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। এভাবে চলতে থাকলে এই পেশা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখতে পারছি না।'
জেলে সোলেমান ও আলমগীর বলেন, 'এখন ইলিশ ভরা মৌসুম যাচ্ছে। নদীতে কিছুটা ইলিশ কম পাওয়া গেলেও আড়তে দাম বেশি। আমাদের কাছ থেকে ইলিশ কিনে সেটি নিলামে দাম তুলে আরো বেশি বিক্রি হয়। এরপর কয়েক হাত রদবদল হয়। যার কারণে দাম বৃদ্ধি।'
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল 'বারী জমাদার মানিক আক্ষেপ করে বলেন, ঘাটঘেঁষা যেই পন্টুনটি রয়েছে সেদিকে তাকালেই বুঝা যাবে ইলিশের বর্তমান চিত্র। এখানে প্রচুর ট্রলার ইলিশ নিয়ে ভিড়ত। আমাদের অবসর থাকাটা ছিল কষ্টসাধ্য! কিন্তু, এখন সরবরাহ কম থাকায় ঘাটে ট্রলার ভিড়ছে কম।'
তথ্যমতে, চাঁদপুরে বর্তমানে ১ কেজি বা তার চেয়ে বেশি পরিমাপের ইলিশ ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর দেড় কেজি পরিমাপের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৯০০ থেকে ২১০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া ৮শ' থেকে ৯শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি দরে।
মৎস্য ব্যবসায়ী মানিক বলেন, 'সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে দরদামে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। কারণ, ভারতে বিশেষ করে পূজা-পার্বণে বিগত দিনে কিছু ইলিশ পাঠানো হতো। কিন্তু, এখন নিজ দেশেই তো ইলিশের দেখা মিলছে কম।'
ইলিশ ব্যবসায়ী নবীর হোসেন বলেন, 'মাছঘাটে কয়েকদিন ধরে প্রচুর ক্রেতা আসছে। আগের তুলনায় ইলিশ সরবরাহ বেড়েছে কিন্তু দাম কমেনি। দাম নিয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রায়ই বাকবিতন্ডা হয়। মাছের তুলনায় ক্রেতা বেশি, যার কারণে দামও বেশি।'
কুমিলস্না থেকে ইলিশ কিনতে আসা আবুল কালাম বলেন, 'ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুর মাছঘাটে এসেছি কম দামে ইলিশ কিনতে। কিন্তু এখানে এসে দেখি ভিন্ন চিত্র। ইলিশের দাম অনেক বেশি। এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৭০০ টাকা চায়। কি কারণে ইলিশের দাম এত বেশি বুঝতে পারছি না।'
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার বলেন, 'দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ও ক্রেতা আসে ইলিশ কিনতে। সরবরাহ কম, আবার চাহিদা বেশি থাকে, তাহলে দাম এমনেই বেড়ে যায়। আশা করছি সামনে সরবরাহ বাড়লে দামও কমবে।'
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ইলিশ পরিভ্রমণশীল। একসময় নদীতে বিচরণ থাকে তারা আবার সাগরে চলে যায়। বিশেষ করে ডিম ছাড়ার সময় মিঠা পানিতে ইলিশ বিচরণ বেড়ে যায়। মৎস্য বিভাগ সব সময়ই জাটকা রক্ষা ও ইলিশের প্রজনন নিশ্চিত করতে কাজ করছে।