প্রতিনিয়ত বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি
হবিগঞ্জে ১৬৭ কি.মি. সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত চাঁদপুরে পোল্ট্রি খামারিদের মাথায় হাত হাটহাজারীতে ক্ষতি ১৪৭ কোটি টাকা
প্রকাশ | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
সপ্তাহব্যাপী বন্যার পর বেরিয়ে আসছে ক্ষয়ক্ষতি। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাবে টানা বন্যায় কয়েক শতাধিক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর, কাঁচা পাকা সড়ক, শস্যক্ষেত, ব্রিজ-কালভার্ট, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নলকূপ, বিদু্যৎ লাইন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বন্যার ভয়াল থাবা থেকে কিছুই বাদ পড়েনি। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বন্যায় হবিগঞ্জের ৭ উপজেলার ১৬৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি শুধু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে নির্মিত ৬২ সড়কের। পানি নেমে যাওয়ার পর সড়কগুলোর ১৬৭ কিলোমিটার জুড়ে বন্যার ক্ষতে ভেসে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবিগঞ্জ সদর উপজেলা। এখানকার ২৪টি সড়কে ৫৮ কিলোমিটারে ছোট-বড় গর্ত ও অনেক স্থান ভেঙে গেছে।
বন্যাকবলিত সড়কের ৪০ কিলোমিটার বানিয়াচং উপজেলায়। এছাড়া আজমিরীগঞ্জে ৩১ কিলোমিটার, চুনারুঘাটে ১৪, বাহুবলে ১১, মাধবপুরে ৭ ও লাখাই উপজেলায় ৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে এলজিইডি।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলায় খোয়াই নদীর বাঁধে এলজিইডির ২১ কিলোমিটার সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকড়া ও রিচি ইউনিয়নের লোকজন এতে দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির স্রোতে জালাবাবাদ এলাকায় খোয়াই নদীর বাঁধে প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত ভাঙন দেখা গেছে। এতে ওই সড়ক দিয়ে মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া মাছুলিয়া-মশাজান এলাকায়ও নদীর দুইপাড়ের বাঁধে নির্মিত এলজিইডির সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলজিইডি হবিগঞ্জের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ইসতিয়াক হাসান জানান, বন্যায় হবিগঞ্জে ১৬৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক মেরামতে প্রয়োজন প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে বানের পানিতে শাহরাস্তি উপজেলা ও জলাবদ্ধতায় সদর এবং ফরিদগঞ্জ উপজেলায় অধিকাংশ পোল্ট্রি খামারগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। তবে কতজন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার সঠিক তথ্য বলতে পারছে না উপজেলাগুলোর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা।
গত কয়েকদিন জেলার শাহরাস্তি, ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বসতবাড়ির সঙ্গে খড়ের গাদা, গোয়ালঘর ও পোল্ট্রি ফার্মগুলো পানির নিচে তলিয়ে আছে। শাহরাস্তি উপজেলার সূচিপাড়া উত্তর, সূচিপাড়া দক্ষিণ, চিতোষী ইউনিয়নের বহু গ্রাম কুমিলস্না, ফেনী ও নোয়াখালী জেলার বানের পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। ফলে এসব এলাকার প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও গবাদিপশু নিয়ে যেতে পারেননি অনেক মানুষ। এ ছাড়া পোল্ট্রি খামারগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুলস্নাহ আল শামীম বলেন, 'বানের পানিতে এখন পর্যন্ত উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে ১৫টি পোল্ট্রি খামার পানিতে তলিয়ে গেছে। ব্যক্তি কেন্দ্রিক পালন করা ২০০-২৫০টি গবাদি পশু আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। পশুগুলোর খাবারের সংকট রয়েছে। আমরা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'গবাদি পশুর বড় ধরনের কোনো খামার এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে এ এলাকায় প্রায় ১০টি খামার আছে। আমাদের মাঠকর্মীরা কাজ করছে। কিছুদিন পর খামারিদের তালিকা ও ক্ষতি নির্ণয় করা হবে।'
চাঁদপুর সদরের বাগাদী, বালিয়া ও চান্দ্রা ইউনিয়নে টানা বৃষ্টিতে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যে কারণে অধিকাংশ খড়ের গাদা, পোল্ট্রি ফার্ম পানির নিচে।
চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা এলাকার খামারি রহমান জানান, 'পানি আসার কারণে ছোট সাইজের মুরগি বিক্রি করে দিয়েছি। পানি কমলে বোঝা যাবে খামারে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।'
একই ইউনিয়নের গাইনগো দীঘি এলাকার খামারি মনির হোসেন। তিনি বলেন, 'খামার তলিয়ে যাওয়ার কারণে আপাতত মুরগি লালন-পালন বন্ধ। আমাদের এলাকার আরও কয়েকজনের খামারের একই অবস্থা। গত এক সপ্তাহে পানি কমছে না।'
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মকবুল হোসেন বলেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি ফার্মের তালিকা তৈরি করিনি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের কর্মীরা কাজ করছে।'
চাঁদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জ্যোতির্ময় ভৌমিক বলেন, জেলার শাহরাস্তি, ফরিদগঞ্জ ও সদর উপজেলায় বানের পানি ও অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জেলায় খামারিদের তথ্য এখন পর্যন্ত আসেনি। উপজেলা থেকে তথ্য এলে তখন পরিসংখ্যান বলা যাবে।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সপ্তাহব্যাপী বন্যার পর বেরিয়ে আসছে ক্ষয়ক্ষতি। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাবে টানা বন্যায় ১৪৭ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর, কাঁচা পাকা সড়ক, শস্যক্ষেত, ব্রিজ-কালভার্ট, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নলকূপ, বিদু্যৎ লাইন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বন্যার ভয়াল থাবা থেকে কিছুই বাদ পড়েনি।
এদিকে, নিরাপদ স্থান থেকে বাড়ি ফিরে অনেকের মাথায় হাত। থাকার চৌকি, রান্নার চুলা, আসবাবপত্র সব কিছুই নষ্ট। অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই আপন ঘরে। অনেকের ঘরবাড়ি বিশেষ করে কাঁচা ও মাটির ঘর বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভেঙে পড়ছে। অনেক গ্রামীণ সড়কের ক্ষতস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে গাড়ি চলাচলে। সড়কের পাশ নরম থাকায় গাড়ির চাপে তা ভেঙে পড়ছে। মাথায় হাত পড়েছে প্রায় ৯ হাজার কৃষকের। আমন বীজতলা, শস্যক্ষেত হারিয়ে পরিবারের উপার্জন বন্ধের উপক্রম। উপার্জন বন্ধ পরিবারের একমাত্র সম্বল মুরগির ফার্ম হারিয়ে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হাটহাজারীতে বন্যায় প্রায় ১৪৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় সড়কের ক্ষতি হয়েছে ২৭২ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা ১০৩.৬৫ কি.মি, ইট বা খোয়া দ্বারা নির্মিত ৮০.৮২ কিলোমিটার ও কাঁচা সড়ক ৮৭.৫৩ কি.মি। কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ৭৪৯ হেক্টর কৃষিজমি। যার মধ্যে শস্যক্ষেত এক হাজার ৬৫৯ ও বীজতলা ৯০ হেক্টর। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩১৮টি। যার মধ্যে সম্পূর্ণ ৯২ ও আংশিক ২২৬ ঘর। ৯০টি ব্রিজ কালভার্টের ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে চারটি ব্রিজ ও ৮৫টি কালভার্ট। ২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক সাতটি, কলেজ ও মাদ্রাসা দুটি করে চারটি।
এদিকে, বিশুদ্ধ খাবার পানির নলকূপ ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ২১৫টি, যার মধ্যে গভীর নলকূপ ৫০৯ ও অগভীর নলকূপ ৭০৬টি। এ ছাড়া ভেসে গেছে এক হাজার ৬৫০টি পুকুরের চাষ করা মাছ। হালদা নদীর বাঁধ ভেঙেছে ০.২৩ কি.মি। ১১০ হেক্টর বনায়ন ও ০.৫ হেক্টর নার্সারি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ক্লিনিক ও ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী থেকে ডিম আহরণকারী ১৫৬টি নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক সরেজমিন প্রদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা আশার আলো দেখছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের আমন চারা ও বীজ প্রদানের উদ্যোগ নিলেও তাতে কৃষকরা তেমন লাভবান হচ্ছেন না বলে জানান তারা। তারা বলেন, অনেকের বীজ বপনের সময় এখন নেই। পাশাপাশি যাদের চারা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের চারা প্রদানের পাশাপাশি যদি সারের ব্যবস্থা করে দেওয়া না হয় তাহলে অধিকাংশ কৃষকই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক বেতন এবং উচ্চমূল্য সার কিটনাশক ক্রয় তাদের পক্ষে অসম্ভব। আমন রোপণের মাস খানিক পরেই ভয়াল এ বন্যা কৃষকদের জন্য অভিশাপ বলে উলেস্নখ করেন অনেকে। তাই সরকারকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে উদাত্ত আহ্বান কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা ঊর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই ক্ষতি পোষাতে কাজ শুরু করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, 'ক্ষতির তালিকা পেয়েছি। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি।'