গুরুদাসপুরে এক বিদ্যালয়ের ১৯ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে
প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
স্কুল খোলার পর দেখা গেল, অনেক ছাত্রী স্কুলে আসছে না। এর মধ্যে সপ্তম, অষ্ঠম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া ১৯ ছাত্রীর স্কুলে অনুপস্থিত থাকার তালিকা করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনে স্কুল বন্ধ থাকাসহ গত দুই মাসে ওই ১৯ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। এমন ঘটনা ঘটেছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার পৌর সদরের চাঁচকৈড় শাহীদা কাশেম পৌর বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯ জন ছাত্রীর বাল্যবিয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা। বাল্যবিয়ের বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষকরা।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্কুল বন্ধ থাকায় অপ্রাপ্ত বয়সি অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় পৌরসভা, মহিলাবিষয়ক কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন, এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীও এসব বিয়ের খোঁজ আগে পাননি। স্কুল খোলার পর ছাত্রীরা অনুপস্থিত থাকায় করা হয় তালিকা। সেই তালিকা অনুযায়ী সরেজমিন বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে খোঁজ নিতে গেলে বিয়ের বিষয়গুলো জানাজানি হয়। ওই ১৯ ছাত্রী সম্প্রতি বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনসহ গত তিন মাসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। তাদের কেউ ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী, অন্যরা ছিল ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী। অভিভাবকরা গোপনে এ বিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে জড়িত এক শ্রেণির বিবাহ রেজিস্ট্রার ও নোটারি পাবলিক, যারা জাল কাগজপত্র তৈরি করে বিয়ে সম্পন্ন করেছেন।
এদিকে অপ্রাপ্ত বয়সে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অভিভাবকরা বলছেন, এলাকায় বখাটেদের উৎপাত, উত্ত্যক্ত করা, অপহরণ চেষ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে তারা মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিতু খাতুন জানায়, স্কুলে এসে দেখে তার বান্ধবী নিপা খাতুন, সেতু, রোজিনা আক্তার, এলেনা খাতুন স্কুলে আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার পাঁচ বান্ধবীসহ স্কুলের ১৯ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। এসব কথা জানার পর তার বাড়ি থেকেও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। অথচ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছে রয়েছে তার।
বাল্যবিয়ে হওয়া অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি পেশায় ভ্যানচালক। ভালো পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, তাই বিয়ে দিয়েছেন। তবে এখন মনে হচ্ছে বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করানোই ভালো ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বাল্যবিয়ে হওয়া আরও এক ছাত্রীর বাবা রমিজুল করিম জানান, তিনি মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিতে চাননি। কিন্তু স্কুলে যাতায়াতের সময় তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা হয়। তাছাড়াও প্রতিবেশী অনেক মেয়ে নিজেদের পছন্দের ছেলেদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। এসব কিছু ভেবে মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক নেগার সুলতানা বলেন, 'বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫০ জন। তার মধ্যে গত দুই মাসেই ১৯ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। এর আগেও অনেক শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। এ বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে তিনি সবাইকে অবগত করেছেন। বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে সপ্তম শ্রেণিতে ৪, অষ্টম শ্রেণিতে ২, নবম শ্রেণিতে ৬, দশম শ্রেণিতে ৭ জন। বর্তমানে স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা খুবই কম। স্কুলে অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করলেও অভিভাবকরা আসতে চান না। এ সপ্তাহে প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে বিদ্যালয়ে একটি সচেতনতামূলক সেমিনার করা হবে। তাছাড়াও উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হবে।'
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেখামনি পারভিন জানান, বাল্যবিয়ের খবর তাদের কেউ জানায় না। যেসব জায়গায় জানতে পারেন সেগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করা হয়। তারপরও ওই বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ করার জন্য ইউএনওকে জানানো হয়েছে।
ইউএনও সালমা আক্তার বলেন, শাহিদা কাশেম পৌর বালিকা বিদ্যালয়ে জনসচেতনতামূলক একটি অভিভাবক সমাবেশ এ সপ্তাহেই করা হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।