জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের কারণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে মধুপুরের খাল-বিলগুলো। দেশীয় প্রজাতির মাছ থেকে শুরু করে জলজ নানাউদ্ভিদ শেওলাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। এর প্রভাবে সৌন্দর্যও বিলীন হচ্ছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। খাল-বিলের পুটকা পানা হিজল তমালের ডালে ডালে বাসা বেঁধে বাস করা পাখিও আগের মতো দেখা মেলে না। শামুক ঝিনুক শাপলা ঢেফল শিঙগিরাসহ জলজ উদ্ভিদও হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিল-ঝিল, নদী, জলাশয় খনন, ড্রেজিং করা, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভয়াশ্রম তৈরি ও মা মাছ-পোনা ধরায় মৎস্য আইন মেনে চলাসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মধুপুর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট বিলের সংখ্যা ৩৬টি। একমাত্র নদীর নাম বংশাই। মোট পুকুর চার হাজার ৪৪৬টি। খালের সংখ্যা পাঁচটি। মৎস্যজীবী রয়েছেন ১৬১৭ জন। মধুপুরে মাছের চাহিদা পাঁচ হাজার ৯৫০ মে. টন। মোট উৎপাদনের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৬৪৭ দশমিক ৬৩ মে. টন। মৎস্য চাষির সংখ্যা ৩৩৯৫ জন।
স্থানীয়রা জানান, মধুপুরের সব চেয়ে বড় দিঘির নাম সুতানালী দিঘি। এটি শোলাকুড়ি গ্রামে অবস্থিত। এ দিঘিতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে মাছ চাষ করা হয়। মাটি পানির গুনাগুন ভালো থাকার কারণে মাছের স্বাদও বেশি।
উপজেলা সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী একটি বিলের নাম হাওদা বিল। এটি কুড়াগাছা-অরণখোলা ইউনিয়নের মাঝ খান দিয়ে বয়ে গেছে। এ বিলের মাছের স্বাদ ও ঐতিহ্য রয়েছে পুরো টাঙ্গাইল জেলা জুড়ে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর এটি। খিরনদী এসে মিলিত হয়েছে এ বিলে। আবার এ বিল গোঁজা খাল হয়ে বংশাই নদীতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। এক সময় সারা বছরজুড়ে পানি থাকত এ বিলে। দেশি প্রজাতির নানা মাছে ছিল ভরপুর। বিলের নালায় চৈত্র মাসে পানি থাকার কারণে মা মাছগুলো ডিম পাড়ার সুযোগ পেত। পুটকা পানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ছিল সজ্জিত। হিজল তমাল গাছ ছিল। গাছে গাছে পাখিরা বসত। শীতকালে অতিথি পাখি আসত এ বিলে। বিলের দুইপাশে কাশফুলে ভরে যেতে।
শুধু এ বিলেই নয় এমন পরিবেশ ছিল মধুপুরের বিলগুলোতে। এখন কালের পরিক্রমায় চাষাবাদ, নালা ভরাট, ধানচাষে কীটনাশক প্রয়োগসহ বিরূপ প্রভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে এসব বিল নদী নালা খাল। এমনটাই জানালেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় মুক্তার হোসেন জানান, এবার জাল কিনে মাছ ধরতে পারছে না। বৃষ্টি কম হওয়ায় খাল বিলে পানি কম। ফলে মাছ কমে গেছে। সামান্য মাছ ধরে খাওয়া চলছে। আব্দুল বাছেদ জানালেন, আগে বর্ষাকালে বৃষ্টি নামলে জাল-জালি নিয়ে পানি নামার ড্রেনে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তারা রাতেও মাছ ধরতেন। শিং মাগুর কই ডারকিনা পুটি চাটার কোন কমতি ছিল না।
শামছুল হক বলেন, এ বিলের মাছ হাট বাজারে নিয়ে গেলে চড়া দামে বেচা যেত। নানা ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যেত। কার্তিক মাসে পানি কমলে বাওয়া উৎসব করা হতো। নৌকা বাইচ হতো বর্ষাকালে। এখন আর আগের সেই ঐতিহ্য নেই।
মধুপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা হচ্ছে। এ সময়ে পানি কম থাকায় মা মাছ ডিম দিতে পারছে না। অবৈধ জালে ধরা পড়েছে। যে কারণে পোনা মাছ বাড়ছে না। বর্ষা না হওয়ায় খাল বিলে আগের মতো পানি হচ্ছে না। অভিযান চালিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ জাল। এ জন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন। দেশীয় মাছ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান এই কর্মকর্তা।