অনলাইন ক্যাসিনোতে লোভনীয় অফারে সর্বশান্ত যুবসমাজ
প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর প্রতিনিধি
দেখলেই মনে হবে তিনি খুবই ধার্মিক ব্যক্তি। পেশায় ছিলেন দর্জি। খুবই দরিদ্র অবস্থায় ছিলেন পরিবার পরিজন নিয়ে। তবে অনলাইনে ক্যাসিনো খেলার ওয়েবসাইটের সন্ধান পেয়ে জড়িয়ে পড়েন জুয়ায়। এর সঙ্গে যোগ হয় নিজের সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। লোভনীয় অফার দিয়ে জুয়ার এই ফাঁদে লোকজন বিড়িয়ে এখন তিনি কোটিপাতি। যুবসমাজ হয়েছে সর্বশান্ত। আর এই ব্যক্তি হলেন চাঁদপুর সদর উপজেলার আশিকাটি ইউনিয়নের রালদিয়া গ্রামের বাসিন্দা শওকত গাজী।
গেস্নারি ক্যাসিনো নামে অনলাইলে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হওয়া চারজন ভুক্তভোগী যুবকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তারা এখন এই জুয়ার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অর্থ হারিয়ে খুবই চিন্তিত এবং পরিবারের কাছেও বলতে পারছেন না তাদের পরিণতি।
সরেজমিন অনলাইন ক্যাসিনোর পরিকল্পনাকারী শওকত গাজীর এলাকায় গিয়ে রালদিয়া গ্রামের বাড়িতে (বৈদ্যগ বাড়ি) তাকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল প্রধানিয়া বলেন, শওকত গাজী ঢাকার মিরপুরে দর্জির কাজ করতেন। গত ৫ বছর আগে তার দোকানে চাল বাকি নিয়ে টাকা দিতে পারেননি। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে খুব দ্রম্নত সময় কোটি কোটি টাকার মালিক। এলাকায় কোটিপতি আর শিল্পপতি বলে তার পরিচয়।
শওকত গাজীর অর্থ সম্পদ এলাকার সব লোকজনের চেয়ে বেশি। জড়িত আছেন অনলাইন ক্যাসিনোতে। এমন তথ্য দিলেন আরও বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তবে তারা নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও দক্ষিণ রালদিয়া জামে মসজিদের একাধিক মুসলিস্নর অভিযোগ, শওকত গাজী গত ৫ বছর আগে আমাদের দক্ষিণ রালদিয়া ও হোসেনপুর জামে মসজিদ বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে করা হবে বলে দেড় লাখ টাকা ঘুষের জন্য নেন। কিন্তু সেই টাকা এখনো ফেরত দেননি। তার এ ধরনের কাজের বিষয়ে সবচাইতে ভালো জানেন মসজিদের উপদেষ্টা ওমর মাল। মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা ওমর মাল বলেন, শওকত গাজীর সঙ্গে গত ৩০ আগস্ট কথা হয়েছে। তিনি ওই ঘুষের টাকা ফেরত দেবেন বলে জানিয়েছেন।
শওকত গাজীর অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায় রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার গল্প জানতে গিয়ে বেরিয়ে আসা নানা তথ্য। তার এই জুয়ার ব্যবসা পরিচালনা করেন বড় ছেলে মোতালেব গাজী এবং সহযোগী ছোট ছেলে মিরাজ গাজী। মোতালেব জুয়ার প্রধান কার্যালয় দুবাইতে আসা-যাওয়া করেন। জুয়ার অনলাইন ও স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হোয়াটস অ্যাপের অ্যাডমিন মোতালেব। স্থানীয়ভাবে ক্যাসিনোর ফাঁদে লোকদের এনে যুক্ত করান শওকত আলীর মেয়ের জামাতা কামাল মিজি ওরফে বাবু।
ক্যাসিনোতে জড়িত যুবকদের মধ্যে শান্ত নামের একজন বলেন, 'আমি অনলাইনে এই জুয়ার সন্ধান পাই। এরপর ১২৫% বোনাসসহ নানা অফারে এতে জড়িয়ে পরি। কিন্তু এই খেলার মধ্যে বিকাশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা দেওয়ার পর যোগাযোগকারী ব্যক্তির নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তারা অনেক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। হোয়াটস অ্যাপ গ্রম্নপে সদস্য ছিল প্রায় দেড় শতাধিক।'
চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট এলাকার ক্যাসিনো জড়িত যুবকদের মধ্যে মানিক, শামীম ও রওশন বলেন, 'আমরা সবাই একই এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু জুয়ার টাকা পরিশোধ করে তাদের না পাওয়া এবং এক সময় জানতে পারলাম কামাল নামে ব্যক্তিই হচ্ছেন এই জুয়ার স্থানীয় দালাল।'
ওই এলাকার প্রবাসী নজরুল ইসলাম (সুমন) বলেন, 'আমি প্রবাসে থাকলেও নানা সামাজিক কাজে জড়িত। সেই সুবাদে শওকত গাজীর মেয়ের জামাতা কামাল মিজির সঙ্গে পরিচয়। তিনি আমার কাছে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে বলে ২০ লাখ টাকা নেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেরত দেননি।'
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য জুয়ার এডমিন মোতালেব গাজীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মোতালেবের বোন জামাতা কামাল মিজি বলেন, 'অনলাইনে ক্যাসিনো এটা কি আমি জানি না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তা সত্য নয়। আমি কোনো জুয়ার সঙ্গে জড়িত না।'
অভিযুক্ত শওকত গাজীর বক্তব্য কয়েক রকম। প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন ক্যাসিনোতে জড়িত না। তিনি বলেন, 'আমি এক সময় দর্জির কাজ করতাম। এখন আমাদের দুবাইতে ব্যবসা আছে (কি ব্যবসা আছে সেটা বলেননি)। ব্যবসার কাজে আমার ছেলেকে বার বার দুবাইতে যেতে হয়।' ক্যাসিনো ও হুন্ডির ব্যবসা পরিচালনার জন্য দুবাই আসা-যাওয়া করে- এমন প্রশ্নে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, 'আমার ছেলে ঢাকা গাজীপুরে নগদের ব্যবসা করে।'
শওকত গাজী বলেন, 'আমি মসজিদের টাকা আত্মসাৎ করিনি। বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে বরাদ্দ এনে দেব বলে দেড় লাখ টাকা নিয়েছি সত্য। যার মাধ্যমে ওই টাকা দিয়েছি, সে টাকা দেয়নি। এরপরও আমি বলছি, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতে।'