মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল সাতকানিয়া-তিতাসে কৃষি ও মৎস্য খাতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কুমিলস্নার তিতাসে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত আমন ধান ক্ষেত -যাযাদি

গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়নের বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। ফলে উপজেলার বাজালিয়া, খাগরিয়া, চরতী, নলুয়া, কাঞ্চনা, পশ্চিম ঢেমশা, সোনাকানিয়া, কেঁওচিয়া ও ছদাহা ইউনিয়নে বন্যা দেখা দেয়। এতে এসব ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ আউশ ধান, আমন ধান, আমন বীজতলা, তরমুজ ও শাকসবজির ক্ষেত পানির নিচে ডুবে যায়। আবার কিছু কিছু ফসলি ক্ষেত পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে উপজেলার ৫ শতাধিক খামার, দীঘি ও পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এতে কৃষি ও মৎস্য খাত মিলিয়ে ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, পুরো উপজেলায় ৪২.৮ হেক্টর আউশ ধান, ১২৯ হেক্টর আমন ধান, আট হেক্টর আমন বীজতলা, এক হেক্টর তরমুজ ও ২৬ হেক্টর শাকসবজির ক্ষেতসহ সর্বমোট ২০৬.৮ হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় তিন হাজার কৃষক চার কোটি ৫৮ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ভারী বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় সাতকানিয়া উপজেলায় ১২২ হেক্টর পুকুর পস্নাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত খামার, দীঘি ও পুকুরের সংখ্যা পাঁচ শতাধিকের বেশি। সব মিলিয়ে এই খাতে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এবার বন্যার চেয়ে অতিবৃষ্টির ফলে বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজালিয়া ইউনিয়নের কোদালা বিলের কৃষক নজির আহমেদ জানান, 'ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে ৬৫ শতক জমিতে আমন ধান রোপণ করেছিলাম। হঠাৎ সৃষ্ট বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে সব তলিয়ে গেছে। এতে ২৫ হাজার টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান রোপণের সময় যেহেতু এখনো আছে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি একই জমিতে ফের রোপণ করব।'

উপজেলার মৎস্য খামারি নাছির উদ্দিন বলেন, 'আমার প্রায় মৎস্য প্রজেক্ট উঁচু এলাকায় হওয়ায় বন্যার পানি স্পর্শ করতে পারেনি। তবে নিম্নাঞ্চলের বেশ কয়েকটি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এর মধ্যে একটি পুকুরে মাস-দেড়েক আগে পোনা অবমুক্ত করেছিলাম। সব পোনা পানিতে ভেসে গেছে। সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য খামারিদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অচিরেই কাটিয়ে উঠতে পারব।'

সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কাজ শুরু করেছিলাম। পুরো উপজেলায় অতিবৃষ্টির কারণে প্রাথমিকভাবে ২০৬.৮ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় তিন হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাকিয়া আবেদীন বলেন, গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বন্যা দেখা দেয়। এতে পুরো উপজেলায় পাঁচ শতাধিক খামার, দীঘি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। কিন্তু এবার বন্যার চেয়ে অতিবৃষ্টির ফলে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

তিতাস (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুমিলস্নার তিতাস উপজেলার গোমতী নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে এবং বাঁধ ভেঙে কয়েকটি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়। এতে অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, ফসলিজমি ও ছোট-বড় পুকুর তলিয়ে কৃষি ও মৎস্য খাতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার ভিটিকান্দি, নারান্দিয়া, জিয়ারকান্দি ও কলাকান্দি ইউনিয়নে বীজতলা, আউশ ধানের জমি ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেতসহ প্রায় ১ হাজার ২৭৯ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ৪ ইউনিয়নে ৩৩৫ হেক্টর ভূমিতে আউশের আবাদ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০৫ হেক্টর জমির ফসল। এছাড়া প্রায় ৯ হেক্টর জমির শাক-সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী উপজেলায় ছোট-বড় পুকুরসহ মাছের প্রজেক্ট রয়েছে ৯৬৮টি, নদী ৩টি, খাল ১০টি ও পস্নাবন ভূমি রয়েছে ১৬টি। ৪২৯টি পুকুর ঢলের পানিতে তলিয়ে ভেসে গেছে প্রায় ২০ লাখ ১০ হাজার টাকার ১০ মে. টন ফিন ফিশ এবং ১৫ লাখ ১০ হাজার টাকার ৩০ লাখ পোনা মাছ। জানা গেছে, বন্যার পানিতে কলাকান্দি ইউনিয়নের খানেবাড়ি গোবিন্দপুর, কালাইচান্দকান্দি, দড়ি মাছিমপুর, কলাকান্দি, কাউরিয়ারচর, আফজালকান্দি, দক্ষিণ ও উত্তর মানিকনগর, ভিটিকান্দি ইউনিয়নের হরিপুর, দাসকান্দি, ঘোষকান্দি, দুলারামপুর (একাংশ), দড়িকান্দি (একাংশ), নারায়ণপুর, রতনপুর, পোড়কান্দি, ভিটিকান্দি ও আলীনগর এবং নারান্দিয়া ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিম নারান্দিয়াসহ উপজেলার প্রায় ত্রিশটি গ্রাম পস্নাবিত হয়। সরেজমিন গেলে উপজেলার কলাকান্দি গ্রামের মো. মোমেন এবং মানিকনগর গ্রামের শাহাবুদ্দিনসহ একাধিক মৎস্য চাষি জানান, ঢলে তাদের বেশির ভাগ পুকুর, মৎস্য প্রজেক্ট তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। এত বড় লোকসান কীভাবে পূরণ করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন চাষিরা। ইতোমধ্যে অনেক চাষি তাদের ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে উপজেলা মৎস্য অফিসে অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন।

উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নাজমা আক্তার জানান, উপজেলার ৪২৯টি পুকুরে ঢলের পানিতে তলিয়ে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার সাঈদ আব্দুলস্নাহ মোস্তাফিন বলেন, বন্যায় উপজেলার ৩ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান, বীজতলা ও অন্যান্য ফসলে প্রায় ২ কোটি ৯২ লাখ টাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে চলতি বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যদি কোনো সরকারি অনুদান আসে তা কৃষকদের দেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে