বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। এখনো পানির নিচে বাসতঘর ও রাস্তাঘাট। যত পানি কমছে, তত ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এদিকে, বন্যাকবলিত দুর্গম এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বানভাসিরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরের শাহারাস্তি উপজেলায় উজান থেকে নেমে আসা পানিতে গত দুই দিনে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার। সোমবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত উপজেলার সুচিপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িঘর পানির নিচে এবং রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের এবং গবাদিপশুর ঘর।
সূচিপারা ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় নিয়েছে আড়াই শতাধিক মানুষ। তারা গত তিন দিন এই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে আছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছে গবাদিপশুসহ হাঁস-মুরগি।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা জাকির হোসেন বেপারী বলেন, 'বাড়ি ঘরে পানি উঠে যাওয়ার কারণে বৃদ্ধা মাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কবে পানি কমবে, সেই চিন্তায় আছি।'
তানিয়া আক্তার নামে গৃহবধূ বলেন, 'শিশুদের নিয়ে গত দুই দিন এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। আমাদের বাড়িঘর সব পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন কি অবস্থায় আছে, তাও জানি না।'
পার্শ্ববর্তী পাথৈর গ্রামের মাহিন হোসেন বলেন, 'আমাদের গ্রামের উত্তর ও দক্ষিণপাড়া সব বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। দেখার জন্য এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। আমরা সরকারের সহযোগিতা কামনা করি।'
একই গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, 'চারদিন আমাদের এলাকায় পানি। কুমিলস্না ও ফেনীর পানি আমাদের এলাকায় চাপ দেওয়ায় ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। ডাকাতিয়া নদী দিয়ে বানের পানি প্রবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কমছে না।'
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সজাগ ফাউন্ডেশনের সদস্য ফয়েজ আহমেদ বলেন, 'আমরা গত কয়েকদিন যারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, তাদের খুঁজে খুঁজে খাবার সামগ্রী দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে দুর্গত মানুষের পাশে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।'
শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইয়াসির আরাফাত বলেন, 'উপজেলার দক্ষিণে ছয়টি ইউনিয়নে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে আরও পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা এসব লোকদের সহযোগিতায় কাজ করছি। অন্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।' এদিকে দুপুরে উপজেলার সূচিপাড়ার ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসানসহ প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তা।
নাঙ্গলকোট (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার নাঙ্গলকোট উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে তিন লাখ মানুষ পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানির নিচে ডুবে গেছে। মানুষজনকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যায় ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘরে পানি উঠায় রান্না করতে না পারায় পানিবন্দি লোকজনকে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ধরনের বন্যা চোখে দেখেননি কখনো। বিভিন্ন লোকজন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করলেও উপজেলার ডাকাতিয়া পাড় ঘেঁষা গ্রামগুলোতে বানভাসি মানুষজন সহায়তা পাচ্ছেন না। ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার আশ্রয়কেন্দ্র ও সড়কের পাশের মানুষজন। ডাকাতিয়া নদীর পাড় ঘেঁষা বাঙ্গড্ডা, রায়কোট উত্তর, রায়কোট, দক্ষিণ, মৌকরা, ঢালুয়া, সাতবাড়ীয়া, বক্সগঞ্জ ইউনিয়ন দূর্গম হওয়ায় সেখানে বানভাসিরা ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন না। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
রায়কোট উত্তর ইউপির পিপড্ডা গ্রামের সর্দার মলিয়া পাড়ে বসবাসরত আমির হোসেন বলেন, তিনি একাই বাড়িতে আছেন। পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র রাস্তাকেন্দ্রিক লোকজন সহায়তা পাচ্ছেন।
একই ইউপির কুকুরিখিল গ্রামের নিউ হক মৎস্য খামারের মালিক আব্দুল হান্নান মজুমদার বলেন, তার ভাই ওবায়দুল হক মজুমদার ও তার ৫০টি পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে তাদের দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৭০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন। টাকা কীভাবে শোধ করবেন, এ নিয়ে চরম চিন্তায় আছেন।
উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউপির পিপড্ডা গ্রামের আরিফুর রহমান মজুমদার বলেন, 'আমার বয়স ১১০ বছর। জীবনে এত বড় বন্যা দেখিনি। আমার বাবার কাছেও শুনিনি। যারা ত্রাণ সহায়তা দেন, যাতে নদীর পাড়ের লোকজন পায়।'
ইউএনও সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, 'তিনতলা ভবনগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দিয়েছি, শুকনো খাবার বিতরণ শুরু করেছি।'
নানিয়ারচর (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে রাঙামাটির নানিয়ারচর বুড়িঘাট মাছ কোম্পানির নিচু এলাকার ঘরবাড়ি। বন্যার পানি প্রবেশ করেছে ঘরের ভেতর। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বন্যাকবলিত ওই এলাকার বাসিন্দারা। উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের মাছ কোম্পানি এলাকায় পানির স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক ঘরবাড়ি। ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি মাটির ঘর। এ ছাড়া উপজেলাজুড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উৎপাদিত ফসলের। অসহায় জীবনযাপন করছেন বুড়িঘাটের মাছ কোম্পানির অনেক পরিবার। উপজেলা প্রশাসনের বাড়তি বরাদ্দ না থাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি এখনো পরিবারগুলোর মধ্যে। করুন অসহায়ভাবে থাকতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে কেউ কেউ রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করলেও অনেকেই সহায় সম্বলটুকু ফেলে আসতে চাইছেন না। অন্যদিকে গবাদিপশুর খাবার, হাঁস-মুরগির বাসস্থান না থাকায় চিন্তার মধ্যে আছেন। উভয় সংকটে বসবাস করছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
লাখাই (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও গত কয়েকদিনের অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে হবিগঞ্জের লাখাইর হাওড়েও বৃদ্ধি পেয়েছিল পানি। এতে করে চলতি বছরের কৃষি এবং মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে। বানের পানিতে আমন ধানের জমিসহ পুকুরের পাড় ডুবে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গুণতে হবে সাধারণ কৃষক ও মৎস্য চাষিদের।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন হাওড়ে বানের পানিতে নিমজ্জিত আমন ২০ হেক্টর, বীজতলা ৭ হেক্টর জমি। এ ছাড়াও মৌসুমি সবজির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ হেক্টর। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাহমুদুল হাসান মিজান ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলাজুড়ে প্রায় ৫০টি পুকুরের প্রায় ১৫০ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৩০-৩৫ লাখ টাকা। ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চিত করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু ইউসুফ।