পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা থেকে প্রবাহিত মাইনী নদী মিলেছে রাঙামাটির লংগদুতে কাচালং নদীর সঙ্গে। ষাটের দশকের আগেকার সময় এই মাইনী নদী পাড়ি দিয়ে রাঙামাটির বিভিন্ন হাটবাজারে আসতেন বণিকরা। সেই মাইনী নদীর যৌবন এখন আর নেই। মৃতপ্রায় মাইনী নদীর নৌপথ খননের উদ্যোগ নিয়েছে খাগড়াছড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগার এলাকার অংশে এখন চলছে খনন কাজ। তবে নদী খননের বালি দিয়ে করা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ (জলাশয়) ভরাট! বাজার সম্প্রসারণের নামে কাপ্তাই হ্রদের বিস্তীর্ণ অংশ ভরাট করছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ একটি মহল।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগারের পাশের মাইনী নদীতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে খননের কাজ করছে পাউবো। আর নদী খননের বালি লোহার পাইপলাইন দিয়ে মাইনীমুখ বাজারের পাশে কাপ্তাই হ্রদে অংশে ফেরা হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদ ভরাট করে বানানো হচ্ছে বালুচর। সেজন্য আগে থেকেই কাপ্তাই হ্রদের দুই অংশের মধ্যে মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। পাউবো'র খনন করা নদীর বালি পাইপলাইনে করে ফেলা হচ্ছে বাঁধ দেওয়া কাপ্তাই হ্রদে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন বাঁধ দেওয়া জায়গাটি আনুমানিক দুই থেকে তিন একর হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমতে থাকায় গত চারমাস ধরে মাইনী নদীর বালি দিয়ে সরকারি সহায়তায় পরিবেশ বিধ্বংসীভাবে হ্রদ ভরাটের এই কাজ চলছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের ফলে পুরো বিস্তীর্ণ এলাকাটি বালিভূমি হয়ে পড়েছে। তবে অন্য সময়ে শুষ্ক মৌসুমে এই এলাকাটি শুষ্ক মাঠ হয়ে থাকতে। বালি দিয়ে ভরাটের কারণে বাঁধ চুইয়ে বালি ও পানির কারণে বাঁধের বাইরে কাপ্তাই হ্রদের অংশটিও চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কমেছে কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষাবাদের ভূমিও।
এ ছাড়া কাপ্তাই হ্রদে পানিভর্তি মৌসুমে বাজার এলাকায় নৌযানের জন্য কয়েকটি নৌঘাটও রয়েছে। হ্রদ ভরাটের কারণে নৌ-ঘাটগুলো কেবল স্মৃতির নিদর্শন হয়ে থাকবে যে এখানে এক সময়ে নৌ-যান ভিড়ত। নদীর বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট করে ভরাটকৃত জায়গাটিতে মাইনীমুখ বাজার সম্প্রসারণ করা হবে। পুরো এই পরিবেশবিধ্বংসী কাজটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ কামাল হোসেন কমল। বাজার সম্প্রসারণের জন্য বলা হলেও মূলত স্থানীয় ভূমিদসু্য একটি চক্র হ্রদ ভরাট করে পস্নট বিক্রয় করবে। হ্রদ ভরাটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে শুরু করে কিছু সাংবাদিকদেরও 'ম্যানেজ' করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল পুরো হ্রদ ভরাট কাজের নেতৃত্ব দিলেও তার পেছনে পরোক্ষভাবে রয়েছেন লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতারা। তবে নদী খননের মাটি দিয়ে হ্রদ ভরাটের অভিযোগটি অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, তাদের কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। জনগণের স্বার্থে সব করা হচ্ছে।
মাইনীমুখ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, 'কলাবাজার, গরু বাজার, কাঠ বাজারের কারণে মাইনীমুখ বাজারের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। মৌখিকভাবে চেয়ারম্যান (মাইনীমুখ ইউপি) আমার সঙ্গে সমন্বয় করছেন যে পাউবোর মাটি যদি এখানে ফেলা হয় সেক্ষেত্রে বাজারটা সম্প্রসারণ করা যাবে। যে কোনো সময় অবৈধ দখলকদার পেছনে দিকে যাচ্ছে; সেটি ঠেকাতে এসি ল্যান্ড সার্ভেয়ার দিয়ে ম্যাপ করেছেন। এরপর সেখানে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাটি ভরাটের পর জায়গাটি জেলা প্রশাসকও নিতে পারেন কিংবা বাজার সম্প্রসারণের জন্যও দিতে পারেন।'
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল বলেন, 'মাইনীমুখ বাজারটি এলাকার মধ্যে একটা বড় বাজার। কিন্তু হাটবারে বাজার বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাই বাজারটি সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাইনী নদী যখন খনন করা হচ্ছে তখন আমরা পাউবোকে বলেছি নদী খননের মাটিগুলো যদি এখানে ভরাটের জন্য ফেলা হয় তাতে আমাদের সুবিধা হয়। তাই জায়গা ভরাটের জন্য এখানে মাটি ফেলা হচ্ছে। এটার সঙ্গে অনেকেই জড়িত আছেন। হ্রদ ভরাটের অনুমতির বিষয়টি আমার জানা নেই।'
লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল দাশ বাবু বলেন, 'আমার কথা কেন আসছে বিষয়টি আমি জানি না। লংগদুর মাইনীমুখ বাজারটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় হাটের দিন ফরেস্ট রেস্ট হাউসের জায়গাতেও বাজার বসে। বাজারটা সম্প্রসারণ খুবই প্রয়োজন জনগণের স্বার্থে। আর যেখানে ভরাট হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ ও মাইনীমুখ মডেল হাইস্কুলের এক একর জায়গা রয়েছে। জায়গা ভরাট হলে স্কুলের বাচ্চারাও খেলাধুলা করতে পারবে। এসব কারণেই বাজারহাট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজার তো জেলা পরিষদের এখানে। আমার কিংবা কমলেরও (ইউপি চেয়ারম্যান) ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। জনগণের স্বার্থেই সব করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী খননের মাটিগুলো তো কোথাও না কোথাও ফেলতে হবে, তাই এখানে ফেলা হচ্ছে। যাতে করে মাঠটা সম্প্রসারণ করা যায় এবং মাটিগুলো ফেলে ভরাট করা যায়।'
ইউএনও সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সেখানে পাউবো লাল পতাকা দিয়ে লে-আউট দিয়েছে, যেন স্থানীয়রা কাপ্তাই হ্রদের খাস জায়গা ব্যবহার ও চাষাবাদ না করে। লে-আউটের বাইরের জায়গা কেন ভরাট করা হচ্ছে সেটি পাউবো ভালো জানতে পারবে। তবে আমি যতদূর জানি সেখানে মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ ও বিদ্যালয়ের মাঠের জায়গা রয়েছে। ইউপি পরিষদের স্থায়ী ভবন ও বিদ্যালয়ের মাঠ সম্প্রসারণের জন্য জায়গা ভরাট করতে পারে।'
পাউবো খাগড়াছড়ির উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, 'আমার প্রকল্পের স্টাডিতেই উলেস্নখ আছে ড্রেজিং করা মাটি-বালি যদি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্কুলের জন্য চাহিদা থাকে সেক্ষেত্রে আমরা তাদের দান করে দিতে পারব। এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে ট্রাক কিংবা পরিবহণের খরচ তারা দেবেন। মাইনীমুখ ইউপির চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের চাহিদার ভিত্তিতে তাদের বালিগুলো দেওয়া হচ্ছে।'
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, 'নদীর নৌপথ খননের মাটি দিয়ে ভরাট করে যদি নৌঘাট বন্ধ হয়ে যায় হ্রদ ভরাট করা হয়; তাহলে এটি পরিবেশবিধ্বংসী কাজ এবং বড় ধরনের অপরাধ। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব এ ধরনের পরিবেশবিধ্বংসী অপতৎপরতা ঠেকাতে যেন দ্রম্নত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।'
কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। প্রতিষ্ঠানটির রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কমান্ডার আশরাফুল আলম ভূঁইয়া জানান, 'কাপ্তাই হ্রদের মৌলিকত্ব রক্ষায় আমাদের যা করণীয় আমরা সবই করব।'
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, 'এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত অভিযোগ আসেনি। আমি এ বিষয়ে অবগত নই। ইউএনও'র মাধ্যমে সরেজমিন পরিদর্শন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'