প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম গহিন সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি শুঁটকি মাছ তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় চোরা কারবারিরা বনের কর্তন নিষিদ্ধ সুন্দরীসহ বিভিন্ন কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করছে শুঁটকি মাছ। এতে বনের গহিনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদ এবং বনের পরিবেশ। আর জেলে নামক এক শ্রেডুর দুর্বৃত্তদের এ কাজে বনবিভাগের কতিপয় দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রজনন মৌসুমে বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং মাছ ধরা পাস পারমিট বন্দ রাখা শুধু কাগজ-কলমে সীমা বন্ধ থাকছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ৪৫০টি নদনদী। এই নদীতে রয়েছে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ। এর মধ্যে ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়াসহ অসংখ্য জলজ প্রাডু। প্রাকৃতিক এই মৎস্য সম্পদ থেকে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে থাকে। বর্তমানে সুন্দরবনে চলছে মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এজন্য জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস বনে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা এবং জেলেদের পাস পারমিট বন্ধ রয়েছে। এমনকি পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কিছু জেলে নামক দুর্বৃত্ত কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফার আশায় অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে। গহিন বনে এবং ছোট খালের আগায় বনের সুন্দরী, পশুর, গেওয়াসহ অনেক প্রজাতির গাছ কেটে স্তরে স্তরে সাজিয়ে বিশেষ কায়দায় বানায় মাচা। পাতকোস্টা, ভোমরখালী, পাশাখালী, গেওয়াখালী, মার্কি, আদাচাকি ও ভদ্রাসহ প্রভৃতি খাল এলাকা উলেস্নখ যোগ্য। পরে বনের অভ্যন্তরে প্রতিটি খাল, নদী, এমনকি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত নিষিদ্ধ খাল থেকে চাকা চিংড়ি মাছ শিকার করে। ওই মাছ মাচায় নিয়ে বনের নিষিদ্ধ সুন্দরী কাঠ পুড়িয়ে শুঁটকি তৈরি করে থাকে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তারা সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার শুঁটকি মাছ তৈরিতে পারদর্শী জেলেদের খরচ বাদে ২৫% কমিশন দিয়ে নিয়ে আসে। আবার সুযোগ বুঝে ওই শুঁটকি চট্টগ্রামের পাইকারি শুঁটকি বাজারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে প্রতি কেজি শুঁটকি মাছ ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযানে দু-একটি শুঁটকির চালান জব্দসহ দুর্বৃত্ত হাতেনাতে আটক হলেও কখনো থেমে নেই এ কাজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে জানান, সুন্দরী গাছের আগুন চিংড়ি মাছ শুকানোর জন্য বেশ ভালো। এতে চিংড়ির রং অনেকটা লালচে হয়। বাজারে ওই চিংড়ির চাহিদা ও দাম বেশি। আগে কয়রার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের চিংড়ি শুকানোর কারখানা ছিল। সেগুলো বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে নষ্ট করার পর থেকে সুন্দরবনের মধ্যেই চিংড়ি শুকানো হয়।
কালাবগি এলাকার জামাল শেখ বলেন, চোরাকারবারি ও বনবিভাগের দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে রয়েছে গভীর সখ্যতা। তা না হলে সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সময় কিভাবে বনের মধ্যে আগুন জালিয়ে শুঁটকি মাছ তৈরি করতে পারে। শুধু তাই না এ সময় সুন্দরবনের পানি সর্বোচ্চ লবণাক্ত থাকে। দুর্বৃত্তদের খাবার পানিও নিকটবর্তী টহল ফাঁড়ি থেকেই জোগান দেওয়া হয়। এ ছাড়া তেল খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বনবিভাগের বোডের মাধ্যমেই নিয়ে আসে। এ পর্যন্ত সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার অগ্নিকান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুঁটকি তৈরির চুলিস্ন বনে অগ্নিকান্ডের একটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।
পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, গত ১ জুন থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ কেজি শুঁটকি, ৩৩৭ কেজি চিংড়ি, ৮৬৫ কেজি কাঁকড়া, বিবিধ মাছ ৮ কেজি, ২৪টি বিষের বোতল, হরিণের মাংস ১৩২ কেজি, ১১টি ট্রলার ও ৭৫টি নৌকা জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় মোট ৬৯টি মামলায় ৭১ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৪৪ জনকে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। আর ২৭ জন আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।