এবার হালদার বাঁধ ভেঙে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা
প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
এবার হালদার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। এর ফলে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পানিবন্দি অর্ধলাখ মানুষ। জেলার ফটিকছড়িতে হালদা নদী, ধুরুং ও সর্তাখালের ৩০ স্থানে পানি ঢুকে শতাধিক গ্রাম পস্নাবিত। দেখা দিয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, হালদার প্রতিরক্ষাকারী বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের প্রায় গ্রাম তলিয়ে গেছে। টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল আর খুলে দেওয়া ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের পানি একীভুত হয়ে হালদা নদীর পানির গতির তীব্রতা বেড়ে যায়। ফলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডস্থ নাজিরহাট নতুন ব্রিজের পশ্চিম পাশ ছালামত দফাদারের বাড়িসংলগ্ন হালদার প্রতিরক্ষাকারী এ বাঁধটি ভেঙে যায়। ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানি হু হু করে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ওই ইউনিয়নসহ ধলই ইউনিয়নের অনেক ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, পুকুর তলিয়ে যায়। মাইক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষিত আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা নিরাপদ জায়গায় সবাইকে সরে যেতে বলা হলেও অধিকাংশ মানুষই তা মানেননি। ফলে রাতেই পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। প্রশাসনসহ এলাকার মানুষ উদ্ধার কাজে নামলেও পর্যাপ্ত নৌকা তদুপুরি পানির প্রচুর ঢলের কারণে পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। তারপরও ঘটনার পর থেকেই উদ্ধার তৎপরতায় ছিলেন সবাই।
এদিকে শুক্রবার সকাল থেকেই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকরা আটকে পড়াদের উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। একইসঙ্গে বিতরণ করেন বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার। তবে শুকনো খাবারের চাইতে রান্না করা খাবারের প্রয়োজনের কথা উলেস্নখ করেন আশ্রয় নেওয়া অনেকেই।
জানা গেছে, স্থানীয়রা ঘটনারদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বালুভর্তি পস্নাষ্টিকের ব্যাগ দিয়ে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু পানির তীব্র স্রোতে শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁধ লাগোয়া বসবাসকারী স্থানীয় সিএনজিচালক দিদার আলম বলেন, সকাল থেকেই পুরো বাড়ির আসবাবপত্র একটি ঘরে তালা মেরে পরিবার নিয়ে ঘরেই অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ সন্ধ্যায় বাঁধটি ভেঙে যায়। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনমতে রাস্তায় উঠি। তিনি বলেন, পানির তীব্রতা এত বেশি ছিল পাড়ে উঠতেই কষ্ট হচ্ছিল। রাতে নাজিরহাট নতুন ব্রিজের উপর অবস্থান করছিলাম। সকালে সস্ত্রীক এসে ঘর থেকে মালামালগুলো বের করছি।
এদিকে পাউবো বলছে বাঁধটি ২০২১ সালে বেড়িবাঁধ করতে চাইলেও পাশে বসবাসকারীদের আপত্তির কারণে করা যায়নি। উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সোহাগ তালুকদার বলেন, ঘটনারদিন নদীর পানি ১৬৮ সেন্টিমিটার ছিল যা বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুক্রবার ১১০ সেন্টিমিটার তাও বিপৎসীমার উপরে। এতে সামান্য এ বাঁধ টিকে থাকা দূষ্কর। আমরা মেরামত করতে পারব ঠিকই এরকম পরিস্থিতি হলে আবারো ভেঙে যাবে। ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, বিগত ৫০ বছরে স্মরণকালের দ্বিতীয় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা। এতে প্রায় শতাধিক গ্রামের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এ এলাকায় হালদা নদী, ধুরুং খাল, সর্তা খালের প্রায় ৩০টি স্থানে বাঁধ ভেঙে এবং নদী-খালের বাঁধ ও পাড় উপচে বিপৎসীমার ১১০ সে.মি. উপরে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এতে শত শত গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো।
দুর্গত এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে বিদু্যৎ নেই। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফলে খবর মিলছে না বিপদে পড়া অনেক মানুষের। কলা, বাঁশের ভেলায় পানিতে ভাসছে মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি। নিম্নাঞ্চলের এক তলা ভবনের ছাদেও উঠে গেছে পানি। পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের, ফসলি জমি। তুলনামূলক উঁচু রাস্তাগুলোও ডুবে যাওয়ায় আশ্রয়ের জায়গা পাচ্ছে না মানুষ।
উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিস সূত্র জানিয়েছেন, পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫০ মেট্রিক টন চাল এবং ৪ লাখ টাকা শুকনো খাবারের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ হয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থাও ত্রাণ দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সকল এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পিআইও আবুল হোসেন জানান- কিছু জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হলেও বেশকিছু স্থানে যাওয়া যাচ্ছে না। বোট দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে- উপজেলার ৩টি স্থানে হালদার বাঁধ ভেঙে গেছে এবং ১৯টি স্থানে বাঁধ বা পাড়ের উপর পানি প্রবাহিত হয়ে শতাধিক গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। এছাড়াও সর্তা খালে ২টি এবং ধুরুং খালে ২টি স্থানে বাঁধ ভেঙে বেশকিছু গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পাউবোর উপ-বিভাগীর প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহাগ তালুকদার বলেন- গত ৫০ বছরে হালদা নদীর পানি ফটিকছড়িতে বিপৎসীমার সর্বোচ্চ ১১০ সে.মি. উপরে প্রবাহিত হয়েছে। স্মরণকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বন্যার কবলে ফটিকছড়ি। নদ-নদীর পানিতে শতাধিক গ্রাম এবং এক লাখের উপরে এখনো মানুষ পানিবন্দি। জানা গেছে- উত্তর ফটিকছড়ির বাগানবাজার, দাঁতমারা, নারায়ণহাট এবং ভূজপুরে বন্যায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়লেও ধীরে এসব এলাকায় পানি কমে এসেছে। ফলে বন্যার উন্নতি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ইউএনও মোজাম্মেল হক।
এদিকে হালদার পানি উপচে লোকলয়ে ঢুকছে। ইতিমধ্যে আশপাশের এলাকা ডুবে গেছে। একইসঙ্গে ফটিকছড়ি নাজিরহাট এলাকায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১০ ফুট রাস্তা ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। সড়কের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে ইট, বালি কংক্রিট। সড়কটি ভেঙে গেলে খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন- ফটিকছড়ি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। উত্তর ফটিকছড়িতে পানি কমেছে। কিছু এলাকায় এখনো অস্বাভাবিক বন্যা। তবে পুরো রাত স্বেচ্ছাসেবকরা ফটিকছড়িতে এসে ত্রাণ সহায়তাসহ বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করছেন এটা সত্যিকারের মানবিকতা। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সহযোগিতা থাকবে তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। পর্যাপ্ত আশ্রয়ণকেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।