বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যার উদ্দেশ্য জখম, হুমকি ও বিস্ফোরক ঘটানোর অপরাধে দেশের বিভিন্ন থানায় সাবেক এমপি, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সদস্যসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে একাধিক মামলা হয়েছে। আঞ্চলিক স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অপরাধে চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনের সাবেক সাংসদ ড. সেলিম মাহমুদসহ ৬২৪ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলাটি করেন সদর উপজেলার ঢালীরঘাট (উত্তর বালিয়া) এলাকার মৃত আলী আকবর খানের ছেলে নুরুল ইসলাম খান। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন, চাঁদপুর সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক মীর।
মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টায় শহরের বাসস্ট্যান্ড ফয়সাল শপিং কমপেস্নক্সের সামনে রাস্তার ওপর দুষ্কৃতিকারীরা হত্যার উদ্দেশে সাধারণ মানুষকে গুরুতর রক্তাক্ত কাটা জখম, হুমকি ও বিস্ফোরক ঘটানোর অপরাধ করেন। ওই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনের সাবেক সাংসদ ড. সেলিম মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
একই মামলায় আসামি করা হয়- সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপুমনি, তার বড়ভাই ডা. জে. আর ওয়াদুদ টিপু, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির সুমন, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জহির, কবির চৌধুরী, ফেরদৌস মোরশেদ জুয়েল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান পারভেজ, বালিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন নবীরসহ ২২৪ জনের নাম উলেস্নখপূর্বক অজ্ঞাতনামা ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে।
চাঁদপুর সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক মীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জে ছাত্র আন্দোলনে মোস্তাক আহমেদ নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করার অভিযোগে হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহিরকে প্রধান আসামি করে ১১১ জনের নামে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে হবিগঞ্জ শহরতলীর উমেদনগর এলাকার এসএম মামুন মিয়া বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলাটি করেন। মামুন ওই গ্রামের লুৎফুর রহমান নানুর ছেলে। মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে রাখা হয়েছে আরও ১৫০ জনকে।
মামলায় জেলা যুবলীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান সেলিম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শাহনেওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী, লাখাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুশফিউল আলম আজাদ, হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিজান, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ তালুকদার ইকবাল, বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন খানসহ ১১১ জনের নাম উলেস্নখ করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায় নৌ-পুলিশের গুলিতে রফিকুল ইসলাম (২১) নিহতের ঘটনায় সদ্যবিদায়ী মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর দৌলতপুর ও শিবালয়) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ, সদ্যবিদায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম খান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান জানু, শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুছ, সদ্যবিদায়ী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলী আহসান মিঠু ও নৌ-পুলিশের ১১ সদস্যসহ ৩৯ জনের নাম উলেস্নখ করে মামলা হয়েছে।
নিহত রফিকুল ইসলাম শিবালয় উপজেলার উলাইল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি রূপসা গ্রামের রহিজ উদ্দিনের ছেলে।
মামলায় বাকি আসামিরা হলেন- শিবালয় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম জনি, শিমুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মুস্তাকিম রহমান খান অনিক, উথলী ইউপি চেয়ারম্যান আব্বাস আলী, শিমুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম মানিক, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরে আলম, নকুল শীল, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সেলিম রেজা, জয় ঘোষ, নজরুল ইসলাম বাবু, বেলস্নাল হোসেন, তুষ্ঠু দত্ত, পিন্টু মিয়া, বরঙ্গাইল এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা খাজা, ঘটনার দিন পাটুরিয়া নৌ-ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশ সদস্য শেখ এমদাদ হোসেনসহ ১১ পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া এই হত্যা মামলায় অজ্ঞাত আরও অজ্ঞাত দুশ' আসামি রয়েছে।
শিবালয় থানার ওসি আব্দুর রউফ সরকার জানান, নিহত রফিকুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলাটি করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, নেত্রকোনা, বারহাট্টা ও দুর্গাপুর প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার বারহাট্টা, দুর্গাপুর, মদন ও সদর থানায় আওয়ামী লীগের ৩৪৫ নেতাকর্মীকে আসামি করে ৫টি মামলা হয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব মামলা হয়। এর মধ্যে তিনটি মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামছুর রহমান ভিপি লিটনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। একটি মামলায় নেত্রকোনা-১, কলমাকান্দা- দুর্গাপুর আসনের এমপি মোশতাক আহমেদ রুহীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
জানা গেছে, ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীরা মদন সরকারি কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী হামলা চালায়। এ ঘটনায় শনিবার রাতে উচিতপুর গ্রামের সাজু মিয়া বাদী হয়ে মদন থানায় মামলা করেন। মামলায় মদন পৌর মেয়র সাইফুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান তালুকদারসহ ৪৪ নেতাকর্মীর নাম উলেস্নখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আরও ৩৫ জনকে আসামি করা হয়।
এদিকে গত ৪ আগস্ট জেলার বারহাট্টা ডেমুরা রেলক্রসিং এলাকায় ছাত্রজনতার ওপর হামলার অভিযোগ এনে বারহাট্টা থানায় মামলা করেন উপজেলার প্রেমনগর গ্রামের আমিনুল ইসলাম। এতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামছুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩৯ জনের নাম উলেস্নখ ও অজ্ঞাতনামা ৬০ জনের নামে মামলা হয়। একই দিন উপজেলা সদরের মাইল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে বারহাট্টা থানায় মামলা করেন পাড়া গরমা গ্রামের আশিক মিয়া। শামছুর রহমানকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত ২৫ জনের নাম উলেস্নখসহ অজ্ঞাতনামা ৪০ জনকে আসামি করা হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় নেত্রকোনা মডেল থানায় শামছুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আওয়ামী লীগের ৩৮ নেতাকর্মীর নাম উলেস্নখসহ আরেকটি মামলা হয়। এতে অজ্ঞাতনামা আসামি আরও ৬০ জন। মামলায় উলেস্নখ করা হয়, গত বছরের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিএনপির কর্মসূচিতে মাইক্রোবাস পোড়ানোসহ নাশকতার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে সোমবার দুর্গাপুর থানায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহীকে প্রধান আসামি করে চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনে আরেকটি মামলা করেন দুর্গাপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার মিঠুন দত্ত। এতে দুর্গাপুর পৌরসভার মেয়র আবদুস ছালাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ও সাবেক সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমানের নাম উলেস্নখ করা হয়।
কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি অসিম কুমার উকিলকে প্রধান আসামি করে এবং তার স্ত্রী বাংলাদেশ যুবমহিলা লীগের সাবেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অধ্যাপক অপু উকিলসহ ১৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মোবারক হোসেন বাদী হয়ে বুধবার দ্রম্নত বিচার আইনে কেন্দুয়া থানায় এই মামলাটি করেন। মামলা নং-১১।
জানা যায়, কেন্দুয়া থানা গেটে অবস্থিত তানজিম শপিং পয়েন্ট অ্যান্ড গিফট কর্নারে ২৮ জুলাই অসিম কুমার উকিল ও অপু উকিলের নেতৃত্বে আ'লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও ত্রাস সৃষ্টিসহ লুটপাট করে। মামলায় অসিম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিল, কেন্দুয়া উপজেলা আ'লীগের সভাপতি আব্দুল কাদির ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য বহিষ্কৃত পৌর মেয়র আসাদুল হক ভূঁইয়া, সদ্য বহিষ্কৃত ইউনিয়ন পরিষদের বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যানসহ ১৪৮ জনকে আসামি করা হয়।
চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, চারঘাটে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়রসহ ৭১ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও অজ্ঞাত আরও ২৫০ জনের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। চারঘাট মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রকলাপের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার উদ্দেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করার অপরাধে উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দীনের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে মঙ্গলবার দুপুরে এ মামলা করেন।
আসামিরা হলেন- পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র একরামুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফকরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুল হাসান (মামুন), সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ হাসান লনি, সরদহ ইউপি চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মধু, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আল মামুন তুষার, ৮নং পৌর কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর, ৩নং পৌর কাউন্সিলর নাজমুল, চারঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান পিকলু, সাবেক কাউন্সিলর আলতাব হোসেনসহ মোট ৭১ জন।