যমুনায় প্রশাসনের সামনেই প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার বালু উত্তোলন

হুমকিতে বাঁধ, ভাঙন আতঙ্কে এলাকাবাসী

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ইমরান হোসাইন লিখন, গাইবান্ধা থেকে ফিরে
গাইবান্ধায় যমুনা নদীর পাড় থেকে এভাবেই তোলা হচ্ছে বালু -যাযাদি
দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় তান্ডব চালাচ্ছে সুইট ও সুজা নামের দুই ব্যক্তির বাল্কহেড নামক বালু উত্তোলনের দৈত্য। এমন কান্ডে উপজেলা শহরসহ নদী রক্ষাকারী বাঁধ ও কয়েকটি গ্রাম বর্তমানে চরম হুমকির মুখে। ইতিমধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অনেক মানুষ। গত মাসের বন্যায় ভাঙনকবলিত বাঁধটি অল্পের জন্য রক্ষা করতে পেরেছেন স্থানীয়রা। ওই দিন গ্রামবাসী সারারাত মাটি ফেলে কোনোভাবে বাঁধটি রক্ষা করে। তার পরও থেমে নেই বালুখেকোদের মহাযজ্ঞ। ইতিমধ্যে যমুনার এই অঞ্চলটি প্রায় কয়েক কিলোমিটার গোলাকৃতির ঘূর্ণিপাকে পরিণত হয়েছে। এখানে নদীভাঙনে কাজ করছেন বালুখেকো সুইট-সুজা। অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ভাঙন রোধে ব্যস্ত সময় পার করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আবার এই কাজেরও সাব-ঠিকাদার বালুখেকো সুইট। গাইবান্ধার ফুলসোরি উপজেলার ভরতখালি হাটের পূর্ব পাশে লক্ষ্য করলেই দেখা মিলবে অথৈ যমুনার বুকে বালু উত্তোলনের কাজ। প্রায় শতাধিক শ্রমিক ও শতকোটি টাকার নানা ধরনের যন্ত্র বসিয়ে এই মহাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। বালু ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের হিসাবমতো এই এলাকায় ২০টি বাল্কহেড বসানো হয়েছে। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয়। কয়েক কিলোমিটারের এই একই জায়গা থেকে গত প্রায় ১২ বছর ধরে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলছে এসব বালু উত্তোলন। যার নেপথ্যে প্রশাসন ও বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতারা থাকলেও প্রকাশ্যে কাজ করেছেন সাঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সুইট ও তার ছোট ভাই সুজাউদ্দৌলা সুজা। স্থানীয়রা বলেন সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আত্মগোপনে থাকা মাহমুদুর রহমান রিপনের সহচর সুইট ও সুজা। সুইট-সুজার নিজস্ব গুন্ডাবাহিনীর সদস্য প্রায় ২০০ জন। তাদের অত্যাচারে পুরো উপজেলাবাসী অতিষ্ঠ। ভয়ে কেউ তাদের অপকর্ম নিয়ে কথা বলতে পারে না। কথা বললেই তাদের নিজস্ব আদালতে তুলে নেওয়া হয়। সেখানে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাঘাটা-ফুলছড়ির সাবেক সাংসদ মাহমুদ হাসান রিপনের সেল্টারেই দুই ভাই তাদের নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। স্থানীয় বাঁশহাটা গ্রামের সোহেল রানা বলেন, 'সুইট চেয়ারম্যান এবং তার ভাই সুজা দীর্ঘ ১২ বছর ধরে অবৈধভাবে যমুনা থেকে বালি উত্তোলন করে আসছে। নদীর কিনারা থেকে এসব বালি তোলায় প্রতিবছর পাড় ভেঙে বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। শত শত বিঘা আবাদি জমি নষ্ট হয়েছে। প্রতিদিন বালি বহনকারী ট্রাক ট্রলির অত্যাচারে গ্রামের সব সড়ক বেহাল। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে গরু-ছাগল মারা গেছে। অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন। তাদের এমন অবৈধ কাজে বাধা দিলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়েছে। ফলে এখন আর কেউ কথা বলার সহস পায় না।' প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে সোহেল বলেন, 'পুলিশকে বললে উল্টো অভিযোগকারীদের শাসন করে যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও অর্থের কাছে মাথানত করে থাকে। কাউকে বলে কোনো কাজ হয় না। সাংবাদিকরাও এসে ছবি তুলে নিয়ে যায়; কিন্তু কোনো পত্রিকায় এসব খবর ছাপা হয় না।' শরীফ নামের এক যুবক বলেন, 'সুইট-সুজা যমুনা থেকে বালি উত্তোলন করেই খ্যান্ত হননি। তারা চরের শত শত বিঘা জমিও দখল করেছেন। বন্যার পড়ে কাশফুলের ক্ষেত কোটি টাকায় বিক্রি করেন। জমির মালিকরা প্রতিবাদটুকুও করতে পারে না।' বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় সুজাউদদৌলা সুজার সঙ্গে। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের জন্য এসব বালি তোলা হচ্ছে। বালি অন্য জায়গায় বিক্রি হচ্ছে সেটি তিনি অস্বীকার করেন। পরে এলাকার মানুষের অত্যাচার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার ভাই বারবার এখানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। যদি অত্যাচার করত তাহলে তিনি চেয়ারম্যান হতে পারতেন না।' সাঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সুইটের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সাঘাটা থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি মাত্র কয়েকদিন আগে এখানে যোগদান করেছি। তখন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ছিল। এখন এসব বিষয়ে অভিযান শুরু হবে। আশা করি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।' সাঘাটা ইউএনও ইসাহাক আলী বলেন, 'আমরা এর আগে দুইবার সেখানে অভিযান চালিয়েছি। তাদের বসানো বাল্কহেড পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। এখন পুলিশকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সেনা সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুলিশ। তারপরও আমরা ওখানে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সাধারণ মানুষ প্রশাসনের বিষয়ে যা বলেছে তা ঠিক নয়।'