ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা
নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর বাঁধ উপচে হাজারও গ্রাম পস্নাবিত পানিবন্দি হাজারও পরিবার বাঁধ ও সড়কে ধস
প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে হাজারো গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আঞ্চলিক স্টাফ রিপোর্টার ও জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার জানিয়েছেন, মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। লাগার বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে এ পর্যন্ত জেলার প্রায় শতাধিক গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষ করে নৌকা না থাকায় বন্যার্তদের উদ্ধার করতে পারছেন না স্বেচ্ছাসেবীরা। চতুর্থ ধাপের হঠাৎ করে আবার বন্যায় পস্নাবিত হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন জেলার কয়েক লাখ মানুষ।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বুধবার জেলার মনু নদীতে (রেলওয়ে ব্রিজ) বিপৎসীমার ১২০ সেমি, চাঁদনীঘাট এলাকায় ৯০ সেমি, ধলাই নদীতে ১৪ সেমি, কুশিয়ারা নদীতে ৩ সেমি ও জুড়ী নদীতে বিপৎসীমার ১৭৮ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও কুশিয়ারা নদীর সদর উপজেলা ও রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ, ফতেপুর, মনুমুখ ও খলিলপুর ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। রাজনগর উপজেলার কামারচাক ও ইউনিয়নের মনুনদের একামধু, মিঠুপুর ও ভাঙ্গার হাটে ভাঙন দেখা দেওয়ায় প্রায় ৩০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। কমলগঞ্জ উপজেলায় ১০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে।
বন্যাকবলিত মানুষ বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন মাঠে না থাকায় বিগত বন্যার মতো তারা সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল ভাঙনের বিষয় নিশ্চিত করে বলেন, 'বাঁধ উপচে পানি যাতে গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে এ জন্য আমরা চেষ্টা করছি।'
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, টানা গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৭১ মিলিমিটার। এখন পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে এবং চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের ভেতরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
বুধবার দুপুরে বৃষ্টিপাতের এই তথ্য জানান চাঁদপুর আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ মো. শোয়েব। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এখন পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত আছে।
টানা বৃষ্টির কারণে বুধবার সকাল থেকে শিশু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় যেতে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও খেটে খাওয়া মানুষ সড়কে নেমেছে। বিশেষ করে রিকশা চালক ও হকারদের সড়কে দেখা গেছে। বৃষ্টিপাতের কারণে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের ভেতরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সড়ক, মাছের ঘের ও বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বহু পরিবার।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আল-আমিন জানান, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সড়ক ও বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। বেড়িবাঁধের পানি না কমায় মাছের ঘেরগুলো নিয়ে খামারিরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। পানিবন্দি লোকজনও পরিবারের শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা ছিল ৩.৭ মিলিমিটার এবং ভাটার সময় ছিল ৩.৬ মিলিমিটার।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়েই চলেছে হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি। নদীর পানি সবগুলো পয়েন্টেই বিপৎসীমার অতিক্রম করেছে। যে কারণে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দুপুর পর্যন্ত খোয়াই নদীর পানি চুনারুঘাটের বালস্না পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর, শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে ১২০ এবং শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অন্যদিকে, কুশিয়ারা নদীর পানি আজমিরীগঞ্জ ও মার্কুলি পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও টানা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণে হবিগঞ্জ শহরের অলিগলিতেও জলজটের সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
হবিগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং উজানের পানি নেমে আসায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বৃষ্টিপাত কমে আসলেই পানি কমে যাবে।
আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার থেকে সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারেও শুরু হয়েছে থেমে থেমে ভারী বর্ষণ। ফলে বুধবার অনেকেই দোকানপাট খুলতে পারেনি। থমকে গেছে এলাকাবাসীর দৈনন্দিন কাজকর্ম।
নারায়ণগঞ্জের মধ্যে আড়াইহাজারের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শিল্পভিত্তিক এলাকা না হলেও এখানে অনেক সাইজিং ও টেক্সটাইল মিল রয়েছে। থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি ও ঘন ঘন হচ্ছে বিদু্যৎ বিভ্রাট। ফলে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শ্রমিক কাজে যোগদান করতে পারেননি। অন্যদিকে পৌরবাজারের অধিকাংশ দোকানপাট রয়েছে বন্ধ। অফিসগুলোতে লোকজনের উপস্থিতি কম লক্ষ করা গেছে। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা লোকজনের ভিড় কম।
বুধবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টির তেমন বিরাম ছিল না। সূর্যের দেখা যায়নি সারাদিনেও। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
রামগঞ্জ (লক্ষ্ণীপুর) প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় টানা বর্ষণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা এবং খাল দখলের ফলে টানা বৃষ্টিতে জলাবন্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ থেকে ৫ ফুট পানির নিচে ডুবে গেছে।
উপজেলার লামচর, ইছাপুর, কাঞ্চনপুর, চন্ডিপুর, করপাড়া ইউনিয়নের সমিতির বাজার ও বাংলাবাজার, নবিনগর বাজার সাহাপুর বাজার আশেপাশের এলাকা, নয়নপুর, নুনিয়াপাড়া, সামদানপুর, শেখপুরা, উত্তর কালিকাপুর, দক্ষিণ কালিকাপুর, কাশিমনগর, রসুলপুর, শৈলখালী, হরিচ্চরসহ অনেক এলাকার ঘরবাড়ি পানির নিচে ডুবে গেছে। ভেসে গেছে কয়েকশ' মাছের ঘের। বহু স্থানে গরু ও মুরগির খামারিদের খামার পানিতে ডুবে গেছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
নুনিয়া পাড়ার সুমনসহ মাছ চাষিরা বলেন, প্রায় ৩শ' পুকুরের অন্তত কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে তাদের। নিম্নাঞ্চলে পুকুর ও ঘের ভেসে বহু জলাশয়ের ছোট বড় মাছ বের হয়ে গেছে। দাদনে টাকা নিয়ে অনেক মাছ চাষি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেছেন বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
এছাড়াও কয়েক হেক্টর আমনের বীজতলা ও শাকসবজির বীজতলা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে।
নারায়ণপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হোসেন লাবলু বলেন, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকা বর্ষার মৌসুমে ডুবে যায়। গত এক সাপ্তাহ প্রবল বর্ষণে উপজেলার নিম্নাঞ্চলসমূহ ৫ থেকে ৭ ফুট পস্নাবিত হয়েছে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
করপাড়ার মেজবাউল হক টিপু জানান, আমাদের এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঢুকে গেছে পানি। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা ডুবে যাওয়ায় যান চলাচলও বিঘ্ন হচ্ছে।
লক্ষ্ণীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদুজ্জামান জানান, 'ফেনীতে পাহাড়ি ঢল এবং নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় রামগঞ্জ ও রায়পুরের নিচু অঞ্চলে পানি বেড়ে গেছে। এছাড়াও প্রভাবশালীরা খালের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেওয়ায় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। খাল খননের জন্য আমরা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। অনুমোদন হলে খাল খনন করা হবে।'