গত কয়েকদিন থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে দেশের বেশ কয়েকটি নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। বিভিন্ন সড়ক ধসে গেছে। চট্টগ্রামের বাঁখালিতে এক শিশুর মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের গজছড়ি খালের ওপর নির্মিত স্স্নুইসগেট ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় ফসল ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ সময় অনেক বসতঘর ও রাস্তাঘাট পানিতে পস্নাবিত হয়।
এ ছাড়াও বাজালিয়া, খাগরিয়া, কেঁওচিয়া ও ছদাহা ইউনিয়নের বেশ কিছু রাস্তাঘাট পস্নাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানি পুকুরে ঢুকে পড়ায় অনেক পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এ ছাড়াও বেশির ভাগ সবজি ক্ষেত ও ধানের বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
জানা যায়, স্থানীয় কৃষকদের চাষাবাদের সুবিধার্থে দীর্ঘদিন আগে উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের গজছড়ি খালের ওপর একটি স্স্নুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছিল। অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলে স্স্নুইসগেটটি ভেঙে যায়। এ সময় গজছড়ি খালের আশপাশের বিলগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ঢলের পানি বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক অতিক্রম করে লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাহাড়ি ঢলের পানি বৃদ্ধি পেয়ে কয়েকটি গ্রাম পস্নাবিত হয়।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে কাঞ্চনা ইউনিয়নের জোটপুকুরিয়া এলাকায় অবস্থিত দক্ষিণ কাঞ্চনা নূর আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়েও পানি ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়াও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হিন্দুপাড়া এলাকার অনেক বাসিন্দার বসতঘর ও রাস্তাঘাট পস্নাবিত হয়েছে। গজছড়ি খালসংলগ্ন ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ সড়ক পাহাড়ি ঢলের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুন নূর তুষার জানান, পাহাড়ি ঢলের পানি সীমিত পরিসরে লোকালয়ে প্রবেশ করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পাহাড়ি ঢলের পানির ধাক্কায় গজছড়ি খালের স্স্নুইসগেটটি ভেঙে গেলে দক্ষিণ কাঞ্চনা ৭ ও ৮ ওয়ার্ড নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ এলাকা পস্নাবিত হতে শুরু করে। এখনো পর্যন্ত পানি ঢুকছে। রাতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে।
স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ছগির আহমদ বলেন, 'আমার ওয়ার্ডের ১০-১৫টি বসতঘরে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। সড়কগুলোর ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষের চলাচলে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। রাতে বৃষ্টিপাত না হলে পানি কমে যাবে বলে ধারণা করছি।'
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, গত শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নিম্নাঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।
রাজস্থলী (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, অতিবর্ষণে বড়ইছড়ি-ঘাগড়া- রাঙামাটি সড়কের কাপ্তাই উপজেলার ৫ নং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের কুকিমারা এলাকায় সড়ক ধসে পড়েছে। ফলে গত রোববার সকাল থেকে এই সড়কে শুধুমাত্র মোটর সাইকেল ছাড়া সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বড়ইছড়ি সিএনজি চালক সমিতির সভাপতি আমীর হোসেন বলেন, গত কয়েকদিনের অতিবর্ষণে বড়ইছড়ি-ঘাগড়া-রাঙামাটি সড়কের কুকিমারা এলাকায় সড়ক ধসে পড়ায় এই সড়কে মোটর সাইকেল ছাড়া সব যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সিএনজিচালক হেমন্ত তনচংগ্যা এবং বড়ইছড়ি-রাঙামাটি বাস মালিক সমিতির লাইন ম্যান মোজ্জামেল হক বাহাদুর বলেন, 'এতদিন ঝুঁকিপূর্ণভাবে এ জায়গায় আমরা গাড়ি চালালেও গত কয়েকদিনের অতি বৃষ্টিতে সড়কের কুকিমারা এলাকায় ধসে গেলে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।'
রাঙামাটি সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, 'আমরা মেরামতের কাজ করছি, আশা করছি শিগগিরই ভাঙা অংশের কাজ মেরামত করে যান চলাচল উপযোগী করা হবে।'
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল দেখতে গিয়ে গত শনিবার দুপুরে উপজেলার পুঁইছড়িতে এক শিশু নিহত ও সাধনপুর ইউনিয়নে দেয়ালচাপায় একজন আহত হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, টানা দুই দিনের ভারী বৃষ্টিতে বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ, চাম্বল, পুঁইছড়ি, সাধনপুর, কালীপুর, বৈলছড়ি, জলদী এলাকায় পাহাড়ি ঢল নেমে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এতে লোকালয়ে হাঁটু পরিমাণ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও পানি জমে থাকার কারণে মাটির ঘর ভেঙে পড়েছে। অনেকের মৎস্য প্রজেক্ট ও কৃষিজমি ডুবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রধান সড়কের পাশাপাশি এসব এলাকার ধানি জমিও ডুবে গেছে। দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে উপজেলার সাধনপুর, কালীপুরের গুনাগরী, বৈলছড়ি ও পৌরসভা এলাকার কয়েকটি স্থানের প্রধান সড়ক টপকে পাহাড়ি ঢলে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ঘর বাড়িসহ স্থাপনা নির্মাণের কারণে স্বাভাবিক পানি চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। যার কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে লোকালয় ডুবে যাচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে পানি নিষ্কাশনের পথগুলো দখলমুক্ত করা উচিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার দুপুরে পুঁইছড়িতে পাহাড়ি ঢল দেখতে গিয়ে ছড়ার মধ্যে পড়ে মারা যায় মোহাম্মদ নোহান (১২) নামের এক শিশু। সে পূর্ব পুঁইছড়ি এলাকার আমির হোসেনের ছেলে। অন্যদিকে, সাধনপুর ইউনিয়নের মাস্টার পাড়ায় একটি মাটির ভেঙে দেয়ালচাপায় দুইটি ছাগল মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ভূপতি দে (৪৭) নামে এক ব্যক্তি।
সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান কে এম সালাহউদ্দিন কামাল জানান, ভারী বর্ষণে সাধনপুর ইউপির বিভিন্ন স্থান পস্নাবিত হয়েছে। পানিতে মাস্টার পাড়ায় একটি মাটির ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে মাটিচাপায় দুইটি ছাগল মারা গেছে এবং ভূপতি দে কালু ও তার স্ত্রী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। কৃষি জমিগুলো পানিতে ডুবে গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রকৌশলী লিপটন ওম জানান, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সাধনপুরে একটি ঘর ভেঙে মাটিচাপায় দুটি ছাগল মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। পুঁইছড়িতে এক শিশুর মৃতু্য হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক জানান, 'বাঁশখালী প্রধান সড়কের পূর্ব পাশের বেশির ভাগ এলাকা এখনও পানির নিচে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে।'
বাঁশখালীর ইউএনও জেসমিন আক্তার বলেন, পাহাড়ি ঢল দেখতে পুঁইছড়িতে গিয়ে এক শিশু নিহত হয়েছে এবং সাধনপুরে দেয়ালচাপায় একজন আহত হয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা ডুবে গিয়ে কৃষি ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পিআইও অফিসে মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানো হবে।