অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে জিরো থেকে হিরো, ফকির থেকে বাদশা, রাজা থেকে মহারাজা, টোকাই থেকে মস্ত বড় লিডার হয়ে সমাজের নেতৃত্ব এখন তারাই দিচ্ছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব্ব ফাঁকি দিয়ে নিজের পকেট ভারী করলেও কোনোই ভ্রম্নক্ষেপ নেই ওইসব সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।
বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের নানা নির্দেশনা থাকলেও এসবের কোনো কার্যকারিতা একেবারেই নেই বললেই চলে। কারণ বিভিন্ন সময় কোটি কোটি টাকা ইজারার মাধ্যমে বালু মহাল ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী ইজারাকৃত উলিস্নখিত পয়েন্টগুলোতে প্রশাসনের নজর থাকে একেবারেই কড়াকড়ি। কারণ একটুখানি হেরফের হলেই হয়ে যায় জরিমানা ও জব্দ। এছাড়া প্রশাসনিক হ্যারেজমেন তো আছেই। তবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। কারণ মোটা অংকের অর্থের বিনিময়েই চলে এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের কাজ। এসবে প্রশাসনের অভিযান কিংবা নজরদারি নেই বললেই চলে। অবৈধতে প্রশাসনের নজরদারী না থাকায় সরকারকে মোটা অংকের রাজস্ব দেওয়া বালু মহালের ইজারাদার, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি, সচেতন মহল, নদীর তীর ও চরের অসহায় মানুষগুলোর কাছে তাদের প্রতি আশা ও ভরসার একটুও জায়গা নেই।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এসব বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ। সরেজমিনে উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের জামথৈল ঘাটে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েক কোটি টাকা মূল্যের মস্ত বড় বড় যন্ত্র। এসব বালু উত্তোলনে ব্যবহার হয় বাল্কহেড নামক দৈতাকৃতির নৌকা, লোডার মেশিন ও আনলোডার মেশিন। তবে প্রশাসনের চোখে পড়ে না। এসব এখনো রয়েই গেছে অগোচরে। স্থানীয়দের দাবি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রশাসন এসব বৈধ বলেই চালিয়ে দেয়।
ঘাটে অবস্থানরত আনলোডারের এক কর্মচারি বলেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক লাখ সিএফটি বালু উত্তোলন করা হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৭ লাখ টাকা।
এসব অবৈধ বালু উত্তোলন পরিচালনা করে থাকে জামালপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মির্জা গোলাম মওলা সোহেল ও সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাহজাহান মোলস্নাসহ আরও প্রায় ১০ জনের একটি টিম।
এ বিষয়ে মির্জা গোলাম মওলা সোহেল বলেন, 'আমি বালু উত্তোলন করি ঠিকই, কিন্তু নিজের কিছু কাজে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারির কাজে।' এর সঙ্গে আর কে কে জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন।' তাদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মাফ করবেন, আমি তাদের নাম বলতে পারব না।'
সাজাহান মোলস্না বলেন, 'এসব আমি তুলি না। ওখানে প্রায় ৫০-৬০ জন এসব বালু উত্তোলন করেন। ওখানে বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কাজ আমি করছি যেগুলো এখনো চলমান রয়েছে।'
এ বিষয়ে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, 'আসলে আমাদের দায়িত্ব হলো বালু উত্তোলনের ফলে কোনো ভাঙন কিংবা ক্ষতি হলো কি না তা দেখা। বাকি দায়দায়িত্ব আমাদের না।'
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বললে, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের আইনের আওতায় আনতে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। উলিস্নখিত জায়গায় আগেও অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানের সময় কাউকে পাওয়া যায়নি। বিগত ছয় মাসে ৬টি মামলা দেওয়া হয়েছে বালু দসু্যদের বিরুদ্ধে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধরতে। কিন্তু দুর্গম এলাকায় হওয়ায় সব সময় তাদের হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয় না।'
উলেস্নখ্য, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনায় উলেস্নখ করা হয়েছে যে, 'হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে বালু উত্তোলন নিমিত্ত ড্রেজিংয়ের এলাকা চিহ্নিত করিয়া হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট, তফসিলসহ মৌজাম্যাপ ও প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রদান করতে হবে।' কিন্ুত্ম এসব কোনো কিছুরই না করে মনগড়া প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের নিকট জমা দেয়।
২০২৩ সালের ইজারা দেওয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, নারাপালা মৌজায় প্রায় ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৫২ ঘনফুট বালু রয়েছে। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরেজমিনে দেখা যায়, নারাপালা মৌজাটি গত দুই বছর পূর্বেই চরে পরিণত হয়েছে। সেখানে নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন হটকারিতায় একদিকে কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে ইজারাদারের, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। কারণ জেলা প্রশাসনের দেখিয়ে দেওয়া স্থানগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত বালু পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি বছরের মে মাসে পুনরায় বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহালী মৌজার ১ নম্বর খতিয়ানে ২নং দাগে ৫০ একর জমি থেকে ৮৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬৪ ঘনফুন উত্তোলন করার নিমিত্তে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, বোহালী মৌজা অংশে একটি নির্দিষ্ট গুগল ম্যাপে প্রদর্শিত অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ এলাকার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ম্যাপের প্রদর্শিত অংশে ৩.০০ থেকে ১২.০০ ফুট গভীরতায় ২৮৯৬৯১৮৪.৯০০ ঘনফুট উত্তোলন করা যেতে পারে। তবে এই প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, অত্র এলাকায় বিট/ভিটি বালু ০.৩০ থেকে ০.৫২ এফ এম এর প্রতি ঘনফুট বালুর বাজার মূল্য ০.৩৫ টাকা হতে ০.৬০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু দুর্গম যমুনার চরের মধ্যে থেকে বিট/ভিটি বালু উত্তোলন করে নূ্যনতম লভ্যাংশ মিলবে না ইজারাদারের। তাহলে এত টাকা ইনভেস্ট করে ইজারা নেওয়ার উদ্দেশ্য অজানা রয়ে যায়।