পাহাড়ের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু প্রাচীন 'মাইনী বাজার'

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

সাকিব আলম মামুন, লংগদু (রাঙামাটি)
রাঙামাটির পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি জনপদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু 'মাইনীমুখ বাজার' -যাযাদি
পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রান্তিক চাষিরা এখানে নিয়ে আসেন তাদের উৎপাদিত ফসল। বেচা-কেনা শেষে আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফেরেন ঘরে। দুর্গম জনপদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু এই 'মাইনীমুখ বাজার'। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদুর পাহাড়ি এলাকার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের বাসিন্দা নরেন চাকমা। নিজের জমিতে চাষ করা সাবারাং, আদা আর জুমের উৎপাদিত ফসল নিয়ে মাইনীমুখ বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন তিনি। সবজি ও হাঁস-মুরগি বিক্রির টাকায় চলে তার সংসার। নরেন চাকমার মতো হাজারও নারী-পুরুষ দেশের সীমান্তবর্তী রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ বাজারে আসেন তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে। শুধু সবজিই নয়, এই অঞ্চলের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বৃহৎ বাজার এটি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এসব পণ্য কিনতে দেশের নানা প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসেন। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত এসব পণ্যের কদরও তাই বেশি। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বসা এই হাটে ৩০ হাজারেরও বেশি লোকের সমাগম হয়। সাপ্তাহিক হাটের দিন শনিবার সরেজমিন গেলে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব ববেন চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এই বাজারের সঙ্গে আমাদের জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে আসি। বাজারে এসেছি পাহাড়ি আলু বিক্রি করতে। এক সময় শুধু পাহাড়িরা এটি ক্রয় করলেও এখন এর চাহিদা বেড়েছে।' বাজার কমিটির নেতারা জানান, এই বাজারে চার শতাধিক স্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতি শনিবার অস্থায়ী দোকান বসে আরও পাঁচ শতাধিক। মাইনীমুখ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন সোহেল বলেন, 'মাইনীমুখ বাজার হলো তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং প্রাচীন হাটগুলোর একটি। প্রতি শনিবার প্রায় তিন কোটি টাকার পণ্য কেনা-বেচা হয় এই হাটে।' গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে এখানকার এলাকার জনগণের উৎপাদিত শাকসবজি পাইকারদের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। প্রতি বাজারে প্রায় হাজারখানেক গরু ওঠে। ছাগলও ওঠে প্রায় একই পরিমাণ। কোরবানির সময় দেশি গরু-ছাগল জোগানের বড় মাধ্যম হয়ে ওঠে মাইনীমুখ বাজার।' স্থানীয় বাসিন্দা মাহিন বলেন, 'আমি তিনটি গরু নিয়ে এসেছি বিক্রি করতে। স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি বিভিন্ন গরুর খামারি এবং ব্যাপারী আসায় দ্রম্নত গরুও বিক্রি হয়ে যায়।' জুমচাষি বিক্রম চাকমা বলেন, 'আমি জুম চাষের পাশাপাশি ছাগল পালন করি। আজ দুটি ছাগল এনেছি। পণ্য বিক্রি করে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য কিনি। এখানে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই পণ্য বেচা-কেনা করা যায়।' চট্টগ্রাম-রাউজানের মুরগি ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, 'আমি মাইনীমুখ বাজার থেকে ২০০ কেজি দেশি মুরগি কিনেছি। লঞ্চযোগে এগুলো রাঙামাটি হয়ে সড়কপথে চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারে নিয়ে যাই। আমি নিয়মিত এই বাজার থেকে চট্টগ্রামে মুরগি সরবরাহ করি।' মাইনীমুখ বাজার নৌপথে রাঙামাটি এবং সড়কপথে খাগড়াছড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা খুব সহজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য নিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া নৌপথে দীঘিনালা ও বাঘাইছড়িসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলার লোকজন নৌকা নিয়ে সহজেই বাজারটিতে যাতায়াত করতে পারেন। কুমিলস্নার দাউদকান্দি এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মারফত আলী চার বছর ধরে এই বাজারে যাতায়াত করছেন। তিনি বলেন, 'চার বছর থেকে আমি মাইনীমুখ বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করি। বিভিন্ন দোকানে কাপড় সরবরাহ করি। দুর্গম এলাকা হলেও রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি এই দুই জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ভালো হওয়ায় সহজেই এখানে পণ্য পাঠানো যায়।' হাটের আগের দিন শুক্রবার বিকালে দেখা যায়, নৌকায় করে বিক্রির জন্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী জড়ো করছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য ওঠানো ও নামানোয় লঞ্চঘাটে ব্যস্ত শত শত শ্রমিক। রাত পর্যন্ত চলে নৌকা থেকে পণ্য নামানোর কাজ। শনিবার সকালের মধ্যেই নৌকায় করে পণ্য নিয়ে বাজারে হাজির হন আশপাশের নারী ও পুরুষরা। কেউ সবজি, কেউ হাঁস-মুরগি, কেউ আনেন গবাদিপশু। সকাল ৯টা থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে পুরো বাজার ভরে ওঠে। বিকাল থেকে শুরু হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের পণ্য নিয়ে যাওয়ার ব্যস্ততা। নৌকা, লঞ্চ, ট্রাক ও পিকআপে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে শুরু হয় পণ্যবোঝাই। এদিকে বৃহত্তর মাইনী বাজারের সব জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে লংগদু থানা পুলিশ, লংগদু সেনা জোন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।