মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামের দবির উদ্দিনের স্ত্রী মাজেদা খাতুন। দিন দশেক আগে গ্রামের আব্দুলস্নাহর অসুস্থ ছাগলের মাংস কিনে রান্না করার সময় তার দুই হাত জ্বালাপোড়া করতে থাকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাতে ফোষ্কা উঠলে হাসাপাতালে দেখান তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন, তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত। একই সঙ্গে আক্রান্ত হন গৃহবধূ কল্পনা খাতুন, আমেনা ও রুশিয়া।
শুধু বেতবাড়িয়া নয়, তার মতো এই উপজেলার অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন অ্যানথ্রাক্সে। উপজেলায় চলতি বছরে গত ৬ মাসে ৩৮৯ জন এই রোগে আক্রোন্ত হন। মাঠপর্যায়ে পশুসম্পদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের তেমন কোনো প্রচারণা না থাকায় ক্রমশ অ্যানথ্রাক্স রোগের বিস্তার ঘটছে বলে দাবি করছেন সচেতন মহল। আর স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স সূত্র জানায়, ২০২১ সালে একই এলাকায় অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের শিকার হয় ৪১৭ জন। তাদের মধ্যে নারী ২২৯ জন এবং পুরুষ ১৮৮ জন। ২০২২ সালে ৫৫০ জন, ২০২৩ সালে ৭৯৪ ও চলতি বছরের ছয় মাসে ৩৮৯ জন এই রোগে আক্রোন্ত হন। রোগাক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রি ও রান্নার প্রস্তুতির সময় এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় গবাদিপশুর সিংহভাগই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সেটি জবাই করে মাংস খাওয়ার কারণে বাসিন্দারা অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে গবাদিপশুকে টিকার আওতায় আনতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্তরা জানান, বাড়ির পাশের লোকজনের গরু-ছাগলের অসুখ হলে তারা গোপন রেখে নিজেরাই জবাই করে স্বল্পমূল্যে মাংস বিক্রি করেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা স্বল্পমূল্যে মাংস কিনে এনে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মাংস খাওয়ার পরপরই মুখসহ বিভিন্ন অঙ্গে চুলকানি দেখা দেয়। এরপর ফুলে ও পানি ঝরে। পরে তারা জানতে পারেন, এটি অ্যানথ্রাক্স রোগ। অনেকেই স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা নেন। পরে এটি না সারলে শরণাপণ্ন হন বিশেষজ্ঞের কাছে।
স্থানীয় বামন্দী বাজারের কসাই ও ক্রেতা সাধারণের কাছ থেকে জানা গেছে, গত এক মাসেও কোনো লোক আসেনি গরু-ছাগল পরীক্ষা করার জন্য। এ জন্য দুই-একটা অসুস্থ পশু জবাই করে বিক্রির সুযোগ নিতেও পারেন মাংস বিক্রেতারা। এ ছাড়া অনেক গেহস্ত ও খামারি অসুস্থ পশু জবাই করে স্থানীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে মাংস বিক্রি করে। ফলে অসুস্থ পশুর মাংস খেয়ে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন অ্যানথ্রাক্স রোগে। এদিকে গাংনী বাজারের মাংস বিক্রেতারা দাবি করেছেন, এই বাজার পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে। এখানে কোনো অসুস্থ পশু জবাই করা হয় না। কিন্তু অন্য হাটবাজারে কোনো তদারকি নেই। ফলে রোগা ও অসুস্থ গরু জবাই করা সহজ। স্থানীয় লোকজনও রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সস্তায় কিনে খায়। ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের মেডিকেল অফিসার এমকে রেজা জানান, সম্প্রতি গাংনী পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অ্যানথ্রাক্স রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ যাতে রোগাক্রান্ত গরু জবাই করতে না পারে, সে জন্য নজরদারি প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, আক্রান্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং অনেকেই সুস্থ।
গাংনী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার আরিফুল ইসলাম জানান, সবখানেই আ্যানথ্রাক্স জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় আছে। ৪০ বছর পর্যন্ত এর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই জীবাণু সক্রিয় হতে পারে। বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই রোগের বিস্তার বেড়েছে। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশুকে জবাই না করার জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণাও চালানো হচ্ছে নিয়মিত। তবে বর্ষা মৌসুমে এই রোগ বৃদ্ধি পায়। আক্রান্ত পশুকে দ্রম্নত হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।