ছাত্রসমাজের আন্দোলনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করার পর আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি ও অনুরোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছেন দুই উপদেষ্টা ডক্টর ইউনুসের বিশ্বস্ত ও সহকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম। তারা তিনজনই হাটহাজারীর কৃতি সন্তান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী ও অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মরহুম দুলা মিয়া সওদাগর। ফারুক-ই-আজম উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মরহুম মনির আহম্মদ চৌধুরীর ছেলে ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম উপজেলার বুড়িশ্চর ইউনিয়নের মরহুম আহমদ মিয়ার মেয়ে।
প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীর বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। দারিদ্র্য দূরীকরণে তার 'ক্ষুদ্রঋণ মডেল' বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। এরজন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সম্মাননার তিনটি পুরস্কার নোবেল, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড ও মার্কিন কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত বিশ্বের ১২ জন ব্যক্তির একজন। সম্প্র্রতি তিনি 'সামাজিক ব্যবসা' শীর্ষক নতুন একটি মডেল তৈরি করেছেন, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এশিয়ার মালয়েশিয়া ও ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক হাটহাজারীর ফরহাদাবাদের সন্তান, ইউনূস সুহৃদ'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তবে দেশের বাইরে থাকায় তিনি এখনো শপথ নিতে পারেননি। দেশে ফেরার পর তিনি শপথ নেবেন বলে জানা গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সমন্বিত যুদ্ধাভিযান 'অপারেশন জ্যাকপট'-এর অভিযানিক দলের উপ-অধিনায়ক ছিলেন ফারুক-ই-আজম। একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ফারুক-ই-আজম ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত। ১৯৭১ সালে তিনি খুলনায় ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে বহু প্রতিকূলতা এবং ঝুঁকি মোকাবিলা করে চট্টগ্রামে পৌঁছান। মে মাসে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ওই সময় তিনি নৌবাহিনীর জন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সিলেক্ট হন। পরবর্তীতে পলাশিতে দুই মাসের ট্রেনিং নেন। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযানের জন্য ৬০ সদস্যের একটি দল নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু এদের মধ্যে ২৩ জন চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাতে পারেননি। বাকি দু'টি দলের ৩৭ জন সদস্য চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযান পরিচালনা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের গতি পরিবর্তন করে দেওয়া এই অপারেশনের অধিনায়ক ছিলেন এ ডবিস্নউ চৌধুরী। উপ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সদ্য এইচএসসি পাস করা তরুণ ফারুক-ই-আজম। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনবাজী নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে তিনি বীর প্রতীক হিসেবে পদক পান। ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক নগরীর মেহেদিবাগ এলাকায় বসবাস করেন। তার স্ত্রী শামিম আরা বেগম 'রমণীয়া'র কর্ণধার।
উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের শুরু থেকে তিনি ছিলেন। সেখানে তিনি গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূলগোষ্ঠীতে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্যাংকের শুরুর দিকে এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পৃথিবীর বহুদেশে মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামের পরামর্শদাতা, প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়নকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার বোর্ডে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন কর্তৃক সুসান এম. ডেভিস লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ পান। তিনি ওয়ার্ল্ড সামিট মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস অ্যাওয়ার্ড ২০০৯ এবং ভিশন অ্যাওয়ার্ড ২০০৯-এ ভূষিত হন। ২০০৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ফরচুন মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন সামিটে অংশগ্রহণ করেন এবং স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অনুষ্ঠিত ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতি নিযুক্ত হন ২০০৭ সালে।
এদিকে হাটহাজারীর এ তিন কৃতি সন্তানের নাম আসার সঙ্গে সঙ্গে হাটহাজারীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অভিনন্দনের ঝড় ওঠে। তারা হাটহাজারীর নক্ষত্র উলেস্নখ করে বলেন, বিশ্বের দরবারে আজ হাটহাজারীর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের কাছে দেশকে একটি রোল মডেল দেশ হিসেবে উপহার দেবেন এ কামনাই সবার।