সারাদেশে প্রতিহিংসার আগুন ভাঙচুর ও লুটপাট
কোম্পানীগঞ্জে ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ রাজশাহীর নগর ভবন ও পুলিশ সদর দপ্তরে ভাঙচুর-লুটপাট
প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
তুমুল শিক্ষার্থী আন্দোলনের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে ভারতে যান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে উলস্নাসে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন মানুষ। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে প্রতিহিংসার আগুনে মুহূর্তের মধ্যে পুড়তে থাকে গোটা দেশ। বিভিন্ন স্থানে বিদায়ী মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধরা। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি ও আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং রাজশাহীর নগর ভবন ও পুলিশ সদর দপ্তরে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন থানা, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গাড়িতে আগুন, ইউএনও কার্যালয়, বাসভবন ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। আমাদের আঞ্চলিক অফিস ও জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত খবর-
রাজশাহী অফিস জানায়, রাজশাহীতে নগর ভবন, পুলিশ সদর দপ্তর, মেয়রের বাড়ি, মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি, পত্রিকা অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়েছে জনতা। সোমবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।
একইভাবে ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের ব্যক্তিগত কার্যালয়সহ দলের নেতাদের আরও অনেক স্থাপনা।
প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজশাহী নগরের সড়কজুড়ে ছড়িয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু সবাইকে রাস্তায় নেমে পতাকা নিয়ে উলস্নাস করতে দেখা যায়। নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় অসংখ্য মানুষ রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছেন। সেখানে মাইকে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কোনো একজনকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও বাজানো হয় বিজয়ের গান।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজশাহী নগর ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। নগর ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে যায়। এ সময় নগর ভবনে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। নগর ভবন থেকে ল্যাপটপ, চেয়ার, টেবিল, এসি, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। নগর ভবনে দুটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। ব্যাংকের শাখায়ও আগুন দেওয়া হয় এবং লুটপাট করা হয়েছে। নগর ভবনের পশ্চিম পাশে আরবান ক্লিনিক ভবনে এটিএম বুথে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় সিটি করপোরেশনের ১৫টি কাউন্সিলরের কার্যালয় এবং কয়েকজন কাউন্সিলরের বাড়িতে। এছাড়া রাজশাহী জেলা পরিষদ ভবন ও সেখানে থাকা সোনালী ব্যাংকে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।
রাজশাহী নগরের সিঅ্যান্ডবির মোড়ে অবস্থিত মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরেও আগুন লাগানো হয়। ভবনের নিচে কয়েকটি গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভবনে ঢুকে লুটপাট চালানো হয়েছে। পুলিশের এই সদর দপ্তরের ভবনের এসি ও সিলিং ফ্যান পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়াও আগুন দেওয়া হয় মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখানে পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্ণীপুর পুলিশ বক্স।
রাজশাহী নগরের উপশহর এলাকায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট চালানোর পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাড়ির সব মালামাল লুট করে লোকজন। এছাড়াও রানীবাজার এলাকায় মেয়র লিটনের ব্যক্তিগত কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। নিচে রাখা গাড়িও পুড়ে যায়। এই ভবনে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লুটপাট করতে দেখা যায়।
আনন্দ মিছিলে যাওয়ার সময় লোকজন নগরের কুমারপাড়া এলাকায় অবস্থিত রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের মালিকানাধীন সরকার টাওয়ারে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এখানে ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। একই এলাকায় রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেন। পরে বুলডোজার নিয়ে এসে ভবন ভাঙা হয়। বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় রাজশাহী কলেজের বঙ্গবন্ধুর মু্যরাল। ভাঙচুর করা হয় সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়।
এছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলাম বেন্টুর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুরসহ তার প্রতিষ্ঠান লবঙ্গ ফাস্টফুট ও চাইনিজ (সাগরপাড়া), লবঙ্গ কনভেনশন (মোলস্নাপাড়া) এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে (কোট স্টেশন মোড়ে) ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
রাজশাহী নগরের কুমারপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালের ব্যক্তিগত কার্যালয়েও ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ভবনের সামনে কয়েকটা মোটর সাইকেল রাখা ছিল, তা-ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নগরের সাগরপাড়া ও গোরহাঙ্গা রেলগেট এলাকায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুটি কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। একজন লোককে একটি জেনারেটর টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এছাড়াও সরকারি নিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকা পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও বাংলার জনপদ, সিল্কসিটি নিউজ, দৈনিক সানশাইন, দৈনিক সোনার দেশ ও রাজশাহী প্রেস ক্লাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। পদ্মাটাইমস অফিসের জানালার গ্রিল পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এদিকে, সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ও বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান বাদশা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এছাড়া জেলা পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহে স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদের বাসায় আগুন দেওয়া হয়। এছাড়াও আগুন দেওয়া হয় রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদের বাড়ি, রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আসাদুজ্জামান আসাদের রাজনৈতিক চেম্বারে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলামসহ কর্মকর্তাদের একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বলেন, 'আমি এই রাজনীতি পছন্দ করি না। সবাইকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।'
কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়িতে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর শেষে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুনসহ বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, বেলা আড়াইটায় শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট বাজারে আনন্দ মিছিল করে। একপর্যায়ে মিছিলকারীদের একটি অংশ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। এরপর ক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়ি বসুরহাট পৌরসভার বড় রাজাপুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালান। হামলাকারীরা এ সময় বাড়ির ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় কিছু ব্যক্তিকে বাড়ির ভেতর থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যেতে দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
স্থানীয়রা আরও জানায়, হামলা-ভাঙচুরের অল্প কিছু সময় আগে ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা সপরিবার বাড়ি ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।
বিক্ষুব্ধরা একে একে বসুরহাট পৌরসভা কার্যালয়, মির্জা টাওয়ার, উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসসহ বেশ কয়েকস্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। এছাড়া বসুরহাট জিরো পয়েন্ট, উপজেলা পরিষদ চত্বরে থাকা বিভিন্ন ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেলও বিস্ফোরিত হয়। এতে ইট-পাটকেলের আঘাতে কয়েকজন আহত হন। তাদের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সসহ বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি ছাড়াও বসুরহাট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে তার ভাগনে ব্যাংক কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাস রাহাতের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে একদল লোক। রাত ৯টায় ওই হামলা হয়। তারা ওই সময় বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। একই সময় বাড়িতে থাকা একটি প্রাইভেট কারে আগুন দেয়। এই দুটি বাড়ি ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কমপক্ষে ২০টি বাড়িসহ উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর করার খবর পাওয়া গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী বলেন, বিক্ষুব্ধ লোকজন ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি বাড়িতেও হামলার খবর শোনা গেছে। তবে কেউ এ নিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করেনি।
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জানান, পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার খবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উলস্নাসে মেতে ওঠে ছাত্র-জনতা। সোমবার দুপুরের পর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিকাল ৪টায় মিছিলকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় আক্রমণ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে থানার ভেতর থেকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করা হয়। এ সময় ১০ জন আহত হন। খবর পেয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় সেনাবহিনীর কয়েকটি টহলদল এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে জেলা বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে পুলিশ সদস্যদের থানা থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
এ ছাড়া মিছিলকারীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স ভবন, ব্যাংক এশিয়া, বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে ও পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটের সামনে থাকা বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি র্মুযাল ভাঙচুর করে।
এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আরটিভির জেলা প্রতিনিধি আজিজুর রহমান পায়েলকে মারধর করা হয়।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, থানার অগ্নিকান্ডে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনো বলা যাবে না। আন্দোলনকারীদের হামলায় জেলায় শতাধিক পুলিশ আহত হয়েছেন।
টঙ্গিবাড়ী ( মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানা মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স ও সোনারং টঙ্গিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন লিটন মাঝির বাড়িতে সোমবার বিকালে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এ সময় থানা পুলিশের সব সদস্য পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স ভবন ও চেয়ারম্যানের বাসভবনসহ তার গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে সেনাবাহিনীর একটি টিম এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সদরপুর (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে উলস্নাসে রাস্তায় বেরিয়ে আসে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে সেস্নাগানে সেস্নাগানে উত্তাল করে তোলে উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক। সদরপুর থানার সামনে মিছিলকারীরা জড়ো হয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান নেয়। এ ব্যাপারে সদরপুর থানা পুলিশ আগে থেকেই তাদের প্রবেশ ফটক বন্ধ করে রাখে। আত্মরক্ষার জন্য থানার ভেতরেই তারা অবস্থান করেন।
গত সোমবার বিকাল ৪টার দিকে সদরপুর সদর ইউনিয়নের পূর্বশ্যামপুর (কৃষ্ণপুর) মোড়ে কয়েক হাজার জনতা সমবেত হয়। ছাত্র জনতার একাংশের মধ্য থেকে পাশেই থাকা সদরপুর আওয়ামী লীগ অফিস কার্যালয় ভাঙচুর চালায়। থানা থেকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এসে অরক্ষিত নবনির্মিত সদরপুর উপজেলা কমপেস্নক্সের ইটের গুঁড়ি নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে কিছু উগ্রপন্থি লোকজন পরিষদ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), উপজেলা চেয়ারম্যান ও সরকারি অন্যান্য অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়। পরবর্তীতে হামলাকারীরা ইউএনও'র বাসভবনে হামলা চালালে উৎসুক জনতা বাসভবনের ভেতরে ঢুকে মালামাল লুটপাট করে। একইসঙ্গে আরেকটি অংশ ইউএনও'র বাসভবনের সামনে থানা নিরাপত্তাকর্মী আনসার ক্যাম্পেও ভাঙচুর লুটপাট করে। বিকাল সাড়ে ৫টায় আরেকটি মিছিল সদরপুর থানায় ঢুকে পড়ে। পুলিশ জীবন আশঙ্কায় পালিয়ে থাকেন। ওই সময় থানার অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী লুটপাট হয়। পাশাপাশি পুলিশের একটি জিপ, পিকআপ ও থানায় থাকা ইউওন'র জিপ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন উপজেলার অনেকে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় সদরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম বাবুল জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দেবেন।
সদরপুর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে পরবর্তী কার্যক্রম চালানো হবে।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কাজী বদরুজ্জামান জানান, এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন কোনোভাবেই দায়ী নয়। উগ্রপন্থি জনতা ও বহিরাগতরা এ ন্যাক্কারজনক হামলা ঘটিয়েছে।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণার আগেই চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কস্থ হাটহাজারী মাদ্রাসা, মেডিকেল গেট, বাসস্ট্যান্ড চত্বর ও চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কস্থ ইছাপুর বাজার এলাকায় অবরোধ করে মিছিল করতে থাকে ছাত্র-জনতার একটি অংশ। মিছিল চলাকালে সরকার পদত্যাগের ঘোষণা আসার পরপরই বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতসহ বিভিন্ন দলের হাজার হাজার মানুষ নেমে আসে সড়কে। বিজয়ী মিছিলের পাশাপাশি চলতে থাকে মিষ্টি বিতরণ। বিজয় মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের এক পর্যায়ে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত উত্তেজিত জনতা হাটহাজারী কলেজ গেট এলাকা, বাজারসহ ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যালয়, ক্লাব, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর করে। একইসঙ্গে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে উত্তেজিত জনতার একটি গ্রম্নফ হাটহাজারী মডেল থানার প্রধান ফটকের তালা ভেঙ্গে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালানোর এক পর্যায়ে পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় সিএনজি চালক মো. জামাল (৫৫), পথচারী সায়েম (১৬), সিনাত (১৯), তামিমসহ (১৮) বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া আহত হন পথচারী রশ্মি আক্তার (২৬), নিহান (১৬), জাহাঙ্গীরসহ (২০) আরও অনেকে। থানার পর হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার মাইকে শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় ঢুকে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং পুলিশকে মাদ্রাসা ছাত্রদের মাদ্রাসায় ঢুকার সুযোগ দিতেও আহ্বান জানান মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বেসিক ব্যাংক, আমেনা বাকি ও সিটি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানো ভাঙচুর আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার সন্ধার আগের শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ উপলক্ষে ছাত্র জনতার বিজয় মিছিল শেষে এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন স্কুল মালিকরা।
জানা গেছে, সরকার প্রধানের পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবরে চিরিরবন্দর উপজেলায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করে আনন্দ উলস্নাস করে। এর কিছুক্ষণ পরে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম আমজাদ হোসেনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমেনা বাকি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে অ্যান্ড কলেজে ও এবি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। একই সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোকলেছুর রহমান বাবুর সিটি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের থাই গস্নাস সাইনবোর্ড ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। বেসিক ব্যাংক চিরিরবন্দর শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মোস্তাক মামুন বলেন, 'এ বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া মিডিয়ার সামনে কথা বলা নিষেধ।'
সিটি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের পরিচালক মোকলেছুর রহমান বাবু বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় ৭০ থেকে ৮০ জনের দুর্বৃত্ত দল আসে বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবের প্রায় ৫০টি কম্পিউটার ল্যাপটপ ও তিনটি পাঁচতলা ভাবনের দরজা জানেলা থাই গস্নাসসহ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি করেছে।'
চিরিরবন্দর ইউএনও একেএম শরীফুল হক বলেন, দুর্বৃত্তরা বেসিক ব্যাংক ও দুটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হয়।
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় এক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারীদের তান্ডবের ভয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দেয় ব্যবসায়ীরা। মুহূর্তেই উপজেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উপজেলা আ'লীগের সভাপতি সাইদুল হক ও পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়িসহ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়াও পৌরসভার সরকারি গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা আ'লীগের সভাপতি সাইদুল হকের পৌরসভার ভান্ডারা এলাকার বাড়িটিতে হামলা চালিয়ে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল ভাঙচুর করা হয়। তার ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি পুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমানের সহোদর গ্রামের বাড়ি এবং পৌর এলাকায় অবস্থিত মোটর সাইকেল শোরুমটিতে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এছাড়াও ভাইস চেয়ারম্যান সোহেল রানা, ছাত্রলীগ নেতা তামিম হোসেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা বাবলু হোসেন, আ'লীগ নেতা তাপস চন্দ্র রায়, যুবলীগ নেতা ফারাজুলসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের আ'লীগ নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। ইউএনও অফিস, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, নির্বাচন অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়।
এদিকে উপজেলা পরিষদ, আ'লীগ অফিস, ডিগ্রি কলেজ, মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্সের প্রধান ফটকের সামনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর র্মুযালগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রগতি ক্লাব এলাকায় অবস্থিত আ'লীগের পার্টি অফিস ও সঙ্গীত বিদ্যালয়টি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব হামলার সময় প্রশাসনের ভূমিকা একেবারেই নীরব ছিল।