নওগাঁর রাণীনগরের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ 'রাণীনগর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়'। সুনামের সঙ্গে দীর্ঘ আট দশকের বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে আদর্শ এই বিদ্যাপিঠটি। এই বিদ্যাপিঠ থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে হাজার হাজার মেধাবী সন্তান দেশ ও দেশের বাইরে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবা দিয়ে আসছে।
সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপিঠটি। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে চলছে টানাহিঁচড়া। বিশেষ করে বিদ্যালয়টি ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবরে গেজেটের মাধ্যমে সরকারিকরণ হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। এরপর থেকে শুরু হয় শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি। বর্তমানে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঝুলছে একাধিক তালা। ওই বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নজরুল ইসলাম, আব্দুস সোবাহান মৃধা ও জুনিয়র শিক্ষক চাঁদ সুলতানা পারভীনের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের চেয়ার নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। এমন কর্মকান্ডের কারণে বিদ্যাপিঠটি তার সুস্থ পাঠদানের পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আবু বকর সিদ্দিক। এরপর ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিলের ৪ তারিখ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুস সোবাহান মৃধা। পরবর্তীতে সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম আমজাদ হোসেনের বড় ছেলের স্ত্রী জুনিয়র শিক্ষক মোরশেদা ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জুনিয়র শিক্ষক চাঁদ সুলতানা পারভীন ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গত জুন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব বুঝে না দেওয়ায় ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক দ্বন্দ্বটি দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দ্রম্নত প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্বটি সমাধান করে পাঠদানের একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় অভিভাবক ও উপজেলাবাসী।
বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাণীনগর বাজারের বাসিন্দা ও অভিভাবক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'চোখের সামনে যখন দেখি শিক্ষক দ্বন্দ্বের বলি হয়ে প্রিয় বিদ্যাপিঠটির সুনাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন খুবই খারাপ লাগে। রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভের শিকার হওয়ায় আজ বিদ্যালয়টির ভালো কোনো কিছু আর অবশিষ্ট নেই।
এমন অবস্থা থেকে যদি দ্রম্নত স্কুলটিকে উদ্ধার করা না যায় তাহলে এক সময় স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর শূন্যের কোঠায় চলে আসবে।'
শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি ১৯৯২ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ প্রধান শিক্ষক হিসেবে এ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত হন। এরপর যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু একটি মামলার কারণে তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর আইনি লড়াই শেষে তার পক্ষে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য রায় দেন নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক। গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে তিনি আদালতের সেই রায়ের কপি বিভিন্ন দপ্তরে দিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান করছে না সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুস সোবাহান মৃধা বলেন, 'গত ৪ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) দুর্গা রানী সিকদার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশের মাধ্যমে আমাকে জ্যৈষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বসহ আর্থিক লেনদেনের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
কিন্তু জোরপূর্বক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জুনিয়র শিক্ষক চাঁদ সুলতানা পারভীন আমার কাছে দায়িত্বভার বুঝে না দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়েছেন।'
বিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক চাঁদ সুলতানা পারভীন বলেন, 'আগেও আমার সঙ্গেও অন্যায় করা হয়েছে, বর্তমানেও অন্যায় করা হচ্ছে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে আমি সোবাহান স্যারের কাছে একটু সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবেন না মর্মে জানতে পেরেছি। কী কারণে সোবাহান স্যার আমার বেতন শিটেও স্বাক্ষর করছেন না সেটাও আমার অজানা। যার কারণে আমি বেতন না পেয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করছি। আর প্রধান শিক্ষকের কক্ষে আমার তালার ওপর যেদিন নজরুল স্যার এসে তালা ঝুলিয়েছেন তারপর থেকে আর আমি ওই কক্ষে প্রবেশ করি না। আমিও চাই এমন জটিল সমস্যার দ্রম্নত আইনগত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক।'
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'দীর্ঘ তদন্ত শেষে আমরা একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানোর ফলে শিক্ষক আব্দুস সোবাহান মৃধাকে অধিদপ্তর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার অর্পণ করেছে। পাশাপাশি বিষয়টির স্থায়ী সমাধানে মন্ত্রণালয় বিদ্যালয় সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য চেয়েছে। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে রাখায় কোনো তথ্যই মন্ত্রণালয়ে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।'
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাইমেনা শারমীন বলেন, তিনি সদ্য এ উপজেলায় যোগদানের পর বিদ্যালয়টির এমন জটিল বিষয়টি অবগত হয়েছেন। দ্রম্নতই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে বিদ্যালয়ের এমন জটিল সমস্যার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।