বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

সাঙ্গু ও ডলু নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই, দেয়াল ধসে ২ জনের মৃতু্য

ভারী বৃষ্টিপাতে পস্নাবিত চট্টগ্রাম-বান্দরবান
স্বদেশ ডেস্ক
  ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া অংশে বিপৎসীমা ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গু নদীর পানি -যাযাদি

টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের নিম্নাঞ্চল। অব্যাহত বৃষ্টিতে সাঙ্গু ও ডলুসহ সেখান বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। এদিকে, সাতকানিয়ায় দেয়াল ধসে দুইজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, নাইক্ষ্যংছড়িতে বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের স্রোতে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষয়গ্রস্ত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় টানা দুই দিনের ভারী বর্ষণে নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন অংশ ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। শুক্রবার রাত থেকে সাঙ্গু ও ডলু নদীর পানি বিপৎসীমা ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় সাঙ্গু নদীর বাজালিয়া অংশের চৌধুরী পাড়া বাঁধের পাশ দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। তবে শনিবার সকাল থেকে বৃষ্টিপাত থেমে রোদের দেখা মিলেছে। এতেই কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন এলাকাবাসী।

উপজেলা বাজালিয়া, পুরানগড়, মাদার্শা ও এওচিয়া ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে ও বন বিভাগের মালিকানাধীন পাহাড় কেটে যেসব ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে, সেসব স্থান কিছু কিছু পাহাড় ধসে পড়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধসের শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অপরদিকে বাজালিয়া ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়া পয়েন্ট দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করা শুরু করলে বাঁধের পার্শ্ববর্তী অনেক পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মালামাল গুছাতে দেখা যায়।

বাজালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. হাবিব বলেন, প্রতিবছর সাঙ্গু নদীর চৌধুরী পাড়ার বাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে। বেশ কয়েকবার বরাদ্দ দেওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত বাঁধটির পুরোপুরি নির্মাণকাজ হয়নি। শিগগিরই বাঁধটি নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

এদিকে কেঁওচিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, শাখা খালগুলোর পানি উপচে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট হাঁটুসমান পানিতে ডুবে রয়েছে। এমনকি অনেক বসতঘরেও পানি ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়াও ঢেমশা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

এ ছাড়াও বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের আফঝল নগর এলাকায় বসতঘরের মাটির দেয়াল ধসে মা ও ছেলের মৃতু্য হয়েছে। এতে আহত হয়েছে আরও এক ছেলে। নিহতরা হলেন- মা কোহিনূর আকতার (৩৫) ও ছেলে মোহাম্মদ ওয়াফি (৫)। একই ঘটনায় অপর ছেলে মোহাম্মদ জারিফ (১২) আহত হন। ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোরশেদুর রহমান চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জানা যায়, ভারী বর্ষণে বসতঘরের মাটির বাড়ির দেয়াল ধসে বৃহস্পতিবার বিকালে ওই তিনজন আহত হলে ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালান স্থানীয়রা। একপর্যায়ে তাদের উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মা কোহিনুর আকতারকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তাহার ছেলে ওয়াফিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম শহরে নেওয়ার পথে সেও মারা যায়।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, পাহাড় ও মাটির দেয়াল ধসের বিষয়ে স্থানীয়দের সতর্ক করা হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ছদাহা ইউনিয়নে দেয়াল ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত লাগোয়া ঘুমধুম ইউনিয়নে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের স্রোতে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

গত তিন দিন এক টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল গেল কয়েক বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা আরও বলেন, মিয়ানমারের ভেতরের ক্রোকোডিংগা, বড়খাল, মুরুংগা খালসহ ফকিরা বাজারের সব পাহাড়ি ঢলের পানি ঘুমধুম সীমান্ত খাল দিয়ে আসার ফলে ইউনিয়নের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সীমান্তবর্তী মধ্যমপাড়া, কেনারপাড়া, বাজারপাড়া, হিন্দুপাড়া, পশ্চিমকূল, ক্যাম্প পাড়ার বাড়িঘর ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইউনিয়নের তুমব্রম্ন উত্তরপাড়া, ঘোনারপাড়া, উলুবনিয়া, তুমব্রম্ন ক্যাম্পপাড়া, পরিষদ থেকে ফকিরাঘোনা, পশ্চিমকুল দুই গলাছিড়া, জলপাইতলী, ঘুমধুম মধ্যমপাড়া, ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক থেকে জলপাইতলি, কচুবনিয়া, বড়ুয়াপাড়া, বড়বিল স্টেশন, ফকিরা পাড়ার পাকা রাস্তাসহ অনেক কাঁচা রাস্তার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় হাজারও মানুষের চলাচলে দুর্ভোগের শেষ নেই। এ ছাড়া, অতি বৃষ্টিতে অনেকের কৃষি জমিতে পাহাড় ধসে এসেছে, অনেকের পুকুর ডুবে মাছ চলে গেছে।

অপরদিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাকঢালা, আসারতলী, ফুলতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ি সোনাইছড়ি সড়ক টানা বর্ষণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে পাকা সড়ক খানখন্দ হয়ে গেছে। পাশাপাশি বাইশারী গর্জনিয়া সড়ক ও গর্জনিয়া - নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া সোনাইছড়ি ও দৌছড়ি ইউনিয়নে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানালেন ইউপি চেয়ারম্যানরা।

বন্যাকবলিত ঘুমধুমের বিভিন্ন গ্রামের রেড় ক্রিসেন্ট এর পক্ষ থেকে গত ২ দিন যাবত শুকনো খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে কয়েকটি পাড়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুমব্রম্ন বাজারে প্রায় দোকানে জলাবদ্ধতা হওয়ায় ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে বালি এসে অনেক কৃষি জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ঘুমধুম ইউনিয়নে অনেক পাকা রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন পাড়ায় অনেকের বাড়ি পাহাড় ধসে অনেকটা ভেঙে গেছে। যেসব রাস্তায় পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ এসে যানচলাচল অনুপযোগী রয়েছে, সেগুলো দ্রম্নত সরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া জানান পানিবন্দি এলাকা ঘুমধুমের বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছ। পাশাপাশি ইতোমধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পানি ও কমতে শুরু হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে ভাইস চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনকে সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সরেজমিন ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যদি পাহাড় ধসে পড়া মাটি সরাতে মালিকপক্ষ ভয় পায়, তাহলে ধসের ছবিসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করলে অনুমতি নিয়ে সরানোর ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও তিনি জানান।

পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, ভারী বৃষ্টিতে খুলনার পাইকগাছার নিম্নাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত বুধবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি গতকাল দিনভর অব্যাহত ছিল। ভারী বৃষ্টিতে পাইকগাছার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এতে পুকুর-ঘেরের মাছ ভেসে যাচ্ছে, ফসল ও বাড়ির উঠান ডুবে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় মাঝারি ও ভারী বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়ায় উপকূল এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেড়িবাঁধের ভেতর ও বাইরের শত শত চিংড়ি ঘের তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। দিনভর বৃষ্টি থাকায় রাস্তায় যানবাহন ঠিকমত চলাচল করেনি। জলমগ্ন এলাকায় যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বের হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন জনগণ। দিনমজুররা কাজ করতে পারেননি। এতে সংসারে টানাটানি পড়েছে। বিভিন্ন খাল, নালা-নর্দমা থেকে পানি উপচে রাস্তা তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

নিম্নচাপের প্রভাবে এলাকার নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিতে পানির স্রোতে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে অনেক এলাকায় ঝুঁকি বেড়েছে। কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ায় সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে উপজেলার চিংড়ি লিজ ঘেরে সদ্য রোপণকৃত আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কিছু রোপা আমনক্ষেত তলিয়ে গেছে। নদীতে ভাটা সরলে পানি নেমে যাবে, এতে ধানের কোনো ক্ষতি হবে না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অসিম কুমার দাশ জানান, বৃষ্টিতে এলাকার লবণাক্ত মাটি ধুয়ে গেলে রোপা আমন চাষের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হবে। পাইকগাছায় প্রায় ৩০ কি. মি. বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ভাটায় পানি নেমে গেলে এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে