জীবিকার তাগিদে দিনমজুরির কাজ করতেন জাকির হোসেন (২০)। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওইদিনই নিহতের মরদেহ নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন সকালে জানাজার পর মরদেহ তার নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা ঘর তৈরির জায়গায় দাফন করা হয়।
ঘটনার সপ্তাহ পেরোলেও থামছে না ছেলেহারা মায়ের কান্না। একমাত্র ছেলের মৃতু্যতে এখন পাগলপ্রায় মা মিছিলি বেগম।
নিহত জাকির হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামে। ওই গ্রামে মৃত ফজলু মিয়ার ছেলে তিনি। রাজধানীর বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন জাকির হোসেন ও তার মা মিছিলি বেগম। জাকির দিনমজুরির কাজ করতেন। এরই মধ্যে চিটাগাং রোড এলাকায় ঠিকাদারের অধীনে ওয়াসার পানির লাইন মেরামতের কাজে যান জাকির। কাজ শেষে বাসায় ফিরবেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ আর সারা দেশেই কারফিউ। তাই আর ঢাকায় মায়ের কাছে ফেরা হয়নি। ২১ জুলাই বিকালে চিটাগাং রোড এলাকায় একটি দোকানে যান। সেসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃতু্য হয় তার। পরে ছেলের উপার্জনের টাকায় বাড়ি-ঘর নির্মাণের জন্য কেনা জায়গায় দাফন করা হয় জাকির হোসেনের লাশ।
গত মঙ্গলবার বিকালে জাকিরের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, গুলিতে প্রাণ হারানো ছেলের কাপড় হাতে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন মা মিছিলি বেগম। কবরস্থানে গিয়েও ছেলেকে ডাকছেন 'বাপ আই আমার কাছে আই, এইযে তোর কাপড়টা নিয়ে যা বাপ।'
জানতে চাইলে মিছিলি বেগম জানান, স্বামী ফজলু মিয়া দরিদ্র দিনমজুর ছিলেন। ভিটেমাটি কিছুই ছিল না। স্বজনদের বাড়িতে বসবাস করতেন। ছেলে জাকিরের বয়স যখন ৫ বছর তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে স্বামী মারা যান। গ্রামে জীবনযাপন সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ছোট জাকিরকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় যান। সেখানে রাস্তা থেকে ভাঙ্গাড়ি কুড়িয়ে, মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে বড় করতে থাকেন। ১৪-১৫ বছর বয়স হওয়ার পর কাজ শুরু করেন জাকির। এতে দুঃখ ঘুচতে শুরু করে তার। ছেলের আয়ের টাকা দিয়ে সম্প্রতি গ্রামে বাড়ি তৈরির জন্য ৯ শতক জায়গা কেনেন। কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি জাকিরের জীবন কেড়ে নিল। মিছিলি বেগম আরও বলেন, 'আমার এখন ডানেও কিছু নাই, বামেও কিছু নাই। আলস্নাহ একটা সন্তান দিছিল। এই সন্তানরে মানুষে মাইরা ফেলছে। সকালেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা কইছে। আর বিকেলেই দুনিয়া ছাইড়া চলে গেছে। কে দেখবো এখন আমারে।'
অকালে ছেলের প্রাণ চলে যাওয়ায় সব স্বপ্নই যেন শেষ হয়ে অন্ধকারে মিছিলি বেগমের দুনিয়া। বৃদ্ধ বয়সে কিভাবে কাটবে সামনের দিনগুলো, কোথায় যাবেন, কী করবেন জানেন না তিনি। অন্যদিকে জাকিরের এমন মৃতু্য কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী।