'বিকালের দিকে আমার পুলাডা ফোন করে কয়ছিলাম ঢাহা নাকি গোলমাল হইতেছে বাবা বাসা থ্যাককা বেড় হইছ না। সন্ধ্যার পর শুনি আমার পুলাডা আর নাই, দুইড্ডা সন্তান মরার পর আমার এই পুলাডারে (এই সন্তানকে) নিয়ে বাঁইচ্চা আছিলাম। এহন এই পুলাডাও মুইরা গেছে। অহন আমি বাঁইচ্চা থাকমু কেমনে, তোমরা কইয়া যাও বাবারে, আমার একমাত্র পুলাডা (একমাত্র সন্তান) আর বাঁইচ্চা নাই। অহন হারাডা দিন ঘরের ভেতর বিছনাই পুইরা থাকলেও কেই আইস্যা মা কইয়া ডাক দ্যায় না।'
এভাবেই নিহত একমাত্র সন্তানের ছবি বুকে জড়িয়ে কান্না করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন ২১ জুলাই গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত তনয় দাস (১৯) এর মা সবিতা রানী দাস। নিহত তনয় দাস কিশোরগঞ্জের হাওড় অধু্যষিত অষ্টগ্রাম উপজেলা বাংগালপাড়া ইউনিয়নের জেলে অধু্যষিত ভাটিরনগর গ্রামের।
তনয় এসএসসি পাস করে এইচএসসি ভর্তিও হয়েছিলেন জেলার কুলিয়ারচর কলেজে। কিন্তু সংসারের অভাব অনটন দূর করতে দুই-আড়াই মাস আগে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকার একটা সেলুনে কাজ শিখতে যান। তনয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো।
মঙ্গলবার দুপুরে অষ্টগ্রাম উপজেলা জেলে অধু্যষিত ভাটিরনগর গ্রামে গিয়ে নিহত তনয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক রুমের একটি ঘরে থাকেন তনয়ের মা- বাবা। এ সময় কথা হয় তনয়ের মা'র সঙ্গে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে উন্মাদের মতো কখনো কাঁদছেন, কখনো বিলাপ করেছেন, আবার কখনো চিৎকার চেচামেচি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে বাবা হরিকান্ত দাস একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুধু চোখের জল ফেলছেন।
উপস্থিত লোকজন ও স্বজনরা জানান, তনয় দাসের কণ্ঠনালীর নিচে গুলি লেগে পিঠ ভেদ করে গুলি বের হয়। ঘটনার পর থেকে তাদের বাসায় প্রতিবেশীরা খাবার নিয়ে এসে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে কখনো অল্প করে খাবার খাওয়াতে পারেন, আবার কখনো পারেন না।
তারা বলেন, তনয়ের বাবা একজন জেলে। তার মা গৃহিণী। প্রতিদিন মাছ ধরে বিক্রি করে তাদের সংসার চলে। তনয় ছিল একমাত্র সন্তান। তনয় জন্মের আগে আরও দুই সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু জন্মের পর তারা মারা যায়। পরে তনয়ের জন্মের পর তারা নতুন করে সুখে দিন পার করছিল। কিন্তু সেদিনের ঘটনায় তনয়ের নিহতের খবর পাওয়ার পর থেকে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা সবিতা রানী উন্মাদের মতো বিলাপ করেছেন। যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো গ্রাম জুড়ে।
সেলুনের মালিক মো. শুভ জানান, তনয়সহ এই সেলুনে আরও চারজন কাজ করে, প্রতিদিনের মতো এই সকালে সেলুন খোলা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই আন্দোলন শুরু হলে দোকানটি বন্ধ করে তনয়সহ সবাই বাসায় চলে যান। সন্ধ্যার দিকে তনয়সহ চার-পাঁচজন মিলে বের হওয়ার পর খবর পান তনয়ের গুলি লেগেছে। হাসপাতালে নেওয়ার পরে জানতে পারেন তনয় আর নেই।