রাজশাহীর দুর্গাপুরে তিন ফসলি জমিতে একের পর এক পুকুর খননের কারণে অনাবাদি হয়ে পড়ছে হাজার হাজার একর কৃষি জমি। কখনো জলাবদ্ধতা আবার কখনো সেচের অভাবে এসব জমিতে এখন ফসল হচ্ছে না। এরই মধ্যে আবার একটি বিলজুড়ে নতুন করে খনন করা হচ্ছে পুকুর। প্রায় ১০০ একর কৃষি জমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে এই পুকুর খননের কাজ চলছে উপজেলার কিশমত গণকৈড় ইউনিয়নের উজালখলসি বিলে।
কৃষকদের ভাষ্যমতে, বিশাল এরিয়া নিয়ে এই পুকুরটি খনন হলে চারপাশের বিপুল পরিমাণ তিন ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। বিশেষ করে সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। এছাড়াও ওই জমিগুলোতে সেচের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। ফলে বাধ্য হয়ে সেগুলোতেও পুকুর খনন করতে দিতে হবে।
তাদের দাবি, পুকুর খননের কারণে এ উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর এভাবে পুকুর খনন চললে কিছু দিনের মধ্যে এ উপজেলায় কৃষি জমি বলে কিছু থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কিশমত গণকৈড় ইউনিয়নের উজালখলসি বিলে প্রায় ১০০ একর (৩০০ বিঘা) জমিতে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় চলছে পুকুর খনন। পুকুর খনন করছেন বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্তিক শাহ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এরশাদ আলী। তারা এলাকায় কৃষি জমি খেকো নামে পরিচিত।
সূত্রমতে, সপ্তাহখানেক আগে খাসি জবাই করে ভূরিভোজ করে কৃষি জমি ধ্বংস করে পুকুর খননের উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে পুকুরে চলছে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ভেকু মেশিন। পুকুর পড়ে রাখা হয়েছে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। ফলে পুকুর খননের প্রতিবাদ বা কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না কৃষকরা।
কৃষকদের দাবি, পুকুর খননের জন্য অধিকাংশ কৃষকই স্বেচ্ছায় জমি দেননি। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে অস্ত্রের দেখিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক কৃষককে না জানিয়েই তাদের জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ওই বিলের জমির মালিক আফজাল হোসেন বলেন, যে বিশাল আকৃতির পুকুর খনন করা হয়েছে এর ফলে আশপাশের জমিগুলোতে আর ফসল হবে না। রাজশাহী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা দুর্গাপুর-পুঠিয়ায় কোনো পুকুর খনন করতে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পুকুর খনন চললেও তার কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং এই পুকুর খননে তার মদদ রয়েছে এবং তার ঘনিষ্ঠজনরা জড়িত এমন অভিযোগও করেন কৃষক আফজাল হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশমত গণকৈড় ইউনিয়নের রাতুয়াল বিলে একটি পুকুর খনন করছেন ওই এলাকার মোস্তাফা নামে এক ব্যক্তি। সেখানে প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর পুকুর খনন চলছে। এ পুকুরের কারণে জলাবদ্ধতা অনাবাদি হয়ে পড়বে আশপাশের প্রায় ৫০০ বিঘা ফসলি জমি।
এছাড়াও দুর্গাপুর আড়ইলের বিলে বেশ কয়েকটি পুকুর খনন করেছেন তাহেরপুর পৌরসভা যুবলীগের সভাপতি সোহেল রানা। বর্তমান তার আরো দুটি পুকুর খননের কাজ চলছে। এই যুবলীগ নেতা এলাকায় এখন কৃষি জমি খেকো হিসেবে সুপরিচিত। তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ দিয়েও কৃষকরা কোনো প্রতিকার পাননি। আড়ইল বিলে পুকুর খনন করায় বর্তমান কৃষির অবশিষ্ট কোনো জমি নেই বললেই চলে। যতটুকু আছে তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে।
পুকুর খননকারী বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্তিক শাহ বলেন, 'প্রভাবশালীরা উজালখলসি বিলের ওই পুকুরটি খনন করছে। আমি ও এরশাদ শুধু দেখভালের দায়িত্বে রয়েছি।'
বিলজুড়ে অবৈধভাবে পুকুর খননের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কিশমত গণকৈড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাহেরপুর পৌরসভার দুই কাউন্সিলর কার্তিক শাহ ও এরশাদ আলী সরকারি নিদের্শনা অমান্য করে এ অঞ্চলে একের পর এক পুকুর খনন করে যাচ্ছে। কারও কিছু বলার নেই, দেখারও কেউ নেই।
তিনি বলেন, বর্তমানে তারা একটি বিল জোরপূর্বক দখলে নিয়ে পুকুর খনন করছে। এই পুকুর খনন বন্ধের জন্য আমি নিজে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসককে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়েছি। কৃষকদের নিয়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেও প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন হাত গুটিয়ে বসে আছি, কিছু করার নেই।
বিষয়টি জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রামাণিকের সঙ্গে তার ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে দুর্গাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমন চৌধুরি জানান, আমরা অভিযান চালাই, মেশিন জব্দ করি, জরিমানা করি। তবে কেন পুকুর খনন বন্ধ হয় না সেটা জানি না।
রাজশাহী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সরকার অসীম কুমার বলেন, আমরা পুকুর খনন বন্ধের পক্ষে। তবে কৃষকরা আমাদের লিখিত অভিযোগ দেন না। কেন দেন না সেটি জানি না। তারপরও আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা বিষয়টি দেখছি।